সারাদিন গর্তে ঘুমিয়ে কাটায় আর রাতে খাবারের খোঁজে বের হয়ে মাটি শুঁকতে থাকে। কখনো পিঁপড়ার বাসা বা উইপোকার ঢিবি খুঁজে পেলে শক্তিশালী নখের থাবায় গুঁড়িয়ে দেয়। প্রায় ছয় মিটার মাটির নিচে গর্তে বাসা তৈরি করে। বলছি প্রাণীকূলে একমাত্র আঁশযুক্ত স্তন্যপায়ী প্রাণী বনরুইয়ের কথা।
বিশ্বে আট প্রজাতির বনরুই দেখা যায়। ইংরেজি নাম প্যাঙ্গুলিন। দাঁত নেই বলে আগে দন্তহীন স্তন্যপায়ী প্রাণীদের দলে অন্তর্ভুক্ত ছিল এরা। তবে বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে এদের ফোলিডাটার (Pholidata) দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যার সদস্য একমাত্র বনরুই। এক সময় বাংলাদেশে মালয়, ভারতীয় এবং চীনা বনরুই অহরহ দেখা মিলতো। কিন্তু এখন চীনা বনরুই ছাড়া বাকিগুলো প্রায়ই বিলুপ্ত। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পাচার হওয়া স্তন্যপায়ী প্রাণী বনরুই।
গবেষকরা বলছেন, চট্টগ্রাম, সিলেট এবং মৌলভীবাজারের বিভিন্ন বনে চীনা প্রজাতির বনরুই দেখা যায়। তবে অবাধ শিকার, পাচার ও বাসস্থান বিনষ্ট হওয়াতে এখন বিলুপ্তির মুখে। সম্প্রতি মহাবিপন্ন প্রাণীর তালিকায় বনরুইকে যুক্ত করেছে প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা-আইইউসিএন।
পাশাপাশি চীন ও ভিয়েতনামে বনরুইয়ের মাংসের প্রচুর চাহিদাও দায়ী। এ কারণে বছরে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, চীন, থাইল্যান্ড এবং আফ্রিকান দেশ থেকে প্রায় ২০ টন বনরুই পাচার হয়। এতে এশিয়ায় বন্যপ্রাণীর এই প্রজাতি মহাবিপন্ন প্রায়। এক সময় চট্টগ্রাম এবং সিলেট বিভাগে দেখা মিললেও এখন আর দেখা নেই পার্বত্য অঞ্চলেও।
বাংলাদেশে বনরুই বিলুপ্তির কারণ
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশে ২০১৫ সালে বনরুইয়ের এক কেজি মাংসের দাম ২০০ থেকে ৪০০ ডলার ছিল। এখন তা ৫০০ ডলারে পৌঁছেছে। পার্বত্য অঞ্চলে শিকার করা বনরুই বিশেষত আলীকদম এবং থানচি হয়ে পাচার হয় মিয়ানমারে। এরপরের গন্তব্য চীনে। সারাদেশ থেকেও বনরুই পাচার হচ্ছে। তবে বিভিন্ন সময় যা আটক হয় তা পাচারের তুলনায় খুবই সামান্য। মূলত মাংসের দাম বেশি হওয়াতে পাচারকারীদের পছন্দের প্রাণী বনরুই। তাই ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে পাচার হচ্ছে বনরুই।
পাচারের পাশাপাশি কতিপয় কবিরাজ কথিত ওষুধ তৈরির নামে বনরুই হত্যা করে ব্যবসাও করছে। চীন এবং ভিয়েতনামেও লোকজ ওষুধ তৈরিতে বনরুই ব্যবহার করা হয়। বনরুইয়ের আঁশ থেকে ওষুধ তৈরির বিষয়ে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই বলে জানান গবেষকরা।
সম্প্রতি বন্যপ্রাণী পাচার বিষয়ক তথ্য-উপাত্ত নির্ণয়ের আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ট্রাফিক’এর প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১০-১৫ সালে ১৫৯টি রুটে বনরুই পাচারে তথ্য মিলেছে। প্রতি কেজি বনরুইয়ের মাংস ৩৫০-৫০০ ডলার পর্যন্ত বিক্রি হয়। ‘প্যাঙ্গলিন ডিস্ট্রিবিউশন এন্ড কনজার্ভেশন ইন বাংলাদেশ’ গবেষণার তথ্যমতে, ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত টানা চার বছর পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় ক্যামেরা বসিয়ে ১৯ ধরণের স্তন্যপায়ী প্রাণী দেখা গেলেও বনরুই দেখা যায়নি।
গবেষণাটির সহকারি গবেষক অনিমেষ ঘোষ অয়ন জানান, ২০১৭ বাংলাদেশে মোট ১১টি সংরক্ষিত ও রক্ষিত বনাঞ্চলের বনরুই নিয়ে জরিপ করা হয়। এরমধ্যে ১১টি বনাঞ্চলের আটটিতে বনরুই পাওয়া গেছে। তবে আশঙ্কার বিষয় হলো ওই বনাঞ্চলোতেও বনরুই শিকারের আলামত মিলেছে।
২০১৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার ১৮৬টি দেশের মধ্যে ‘কনভেনশন অন ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইন এনডেঞ্জার্ড স্পেসিস (CITES)’ নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এতে বনরুই বাণিজ্যে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। তবে কোনভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে বনরুই পাচার।
ডব্লিউডব্লিউএফ’র জরিপ বলছে, ২০১১-১৩ সালে বিশ্বে প্রায় দুই লাখ বনরুই পাচারের সময় জব্দ করা হয়। জব্দ করা বনরুই মোট পাচার হওয়ার মাত্র ১০ শতাংশ। ভারত, মিয়ানমার, বাংলাদেশ, চায়না, থাইল্যান্ড এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে গত ১৬ বছরে অন্তত ১৬ লাখ বনরুই পাচার হয়।
মৌলভীবাজারের রাজকান্দি সংরক্ষিত বন ও হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান থেকে বনরুই পাচারের তথ্য পাওয়া গেছে। এ বছরের ২৩ মে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরে পাচারকারীদের কাছ থেকে একটি বনরুই উদ্ধার করে স্থানীয় পুলিশ। সীমান্ত এলাকা থেকে এ বছর চারটি বনরুই উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানায় বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট।
আইইউসিএন’র এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এতদিন বনরুই পাচারে এশিয়া ছিল পাচারকারীদের প্রধান লক্ষ্য। কিন্তু এশিয়াতে প্রাণীটির সংখ্যা কমে যাওয়াতে পাচারকারীদের নজর এখন আফ্রিকাতে। এ বছরের এপ্রিলে নাইজেরিয়া থেকে আসা বনরুইয়ের দু’টি চালান আটক করা হয় সিঙ্গাপুরে। যেখান প্রায় ২৮ টনের মত বনরুইয়ের আঁশ ছিল। যা অন্তত ৭২ হাজার বনরুই হত্যা করে সংগ্রহ করা হয়।
সংস্থাটির পরিচালক এস এম জহির আকন জানান, “বনরুই পাচার ঠেকাতে আমরা সক্রিয় রয়েছি। এ বছরে চারটি বনরুই উদ্ধার করা হয়। সেইসেঙ্গ বনরুই নিয়ে গবেষণা এবং সংরক্ষণে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। যা প্রস্তাব আকারে আছে।” এছাড়া যেসব এলাকায় বনরুই আছে সেসব এলাকায় সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।