প্রকৃতির অনন্য একটি অংশ বিভিন্ন প্রজাতির পতঙ্গ। যারা শুধু সৌন্দর্যেই নয়, মানবজাতি ও পৃথিবীর কল্যাণে পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। মানুষের দৃষ্টির অগোচরেই অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে তাদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তেমনি দুটি পতঙ্গ প্রজাপতি। বাংলাদেশ ছোট একটি দেশ হলেও ২২টি জীব-বৈচিত্র্যের অংশে বিভক্ত। এই ভৌগলিক বৈচিত্র্যময়তার কারণে এখানে রয়েছে চারশোরও বেশি প্রজাপতি। কিন্তু বাংলাদেশর গঙ্গা প্লাবনভূমির নিম্নাংশের প্রজাপতিদের গল্প একেবারে অজানা।
স্রোতস্বিনী পদ্মা তার চলার পথে স্রোতধারায় তার পার্শবর্তী জনপদকে করেছে সমৃদ্ধ, উর্বর। তবে চলার পথে পদ্মা তার পুরো এলাকাকেই করেছে জীব বৈচিত্র্য আর প্রকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ। তেমনি একটি অঞ্চল নিম্ন পদ্মা অববাহিকা প্লাবনভূমি যা বাংলাদেশের ২২টি বায়ো-ইকোলজিক্যাল অংশের একটি। ইংরেজিতে বলা হয় – লোয়ার গ্যাঞ্জেস ফ্লাডপ্ল্যান। বৃহত্তর ফরিদপুর (ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ জেলার কিছু অংশ), বরিশাল, বৃহত্তর যশোর (যশোর, মাগুরা, নড়াইল), বৃহত্তর কুষ্টিয়া (কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর) জেলার সমম্বয়ে গঠিত নিম্ন পদ্মা অববাহিকা অঞ্চল। এখানে যেমন রয়েছে জলাভূমি সমৃদ্ধ বাঁওড়, বিল, খাল, নদী সমৃদ্ধ জীব বৈচিত্র্যের আবাসস্থল; ঠিক তেমনিভাবে বিভিন্ন ছোট ছোট বন, মানব বসতির আশেপাশের বাগান সহ প্রাকৃতিক পরিবেশ। যা আবাসস্থল হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে অসংখ্য পতঙ্গের, বিশেষ করে প্রজাপতি এবং ফড়িংএর।
গঙ্গা নিম্ন প্লাবনভূমির বিভিন্ন জেলা ঘুরে ঘুরে আমার বেড়ে ওঠা আর এখানেই জন্ম। শৈশব থেকেই বন বনানীর প্রতি অন্যরকম এক ভালোলাগা কাজ করতো। আর স্নাতক জীবনে পড়ালেখার বিষয় ছিলো প্রাণিবিদ্যা। আর শুরু থেকে ছিলো ফড়িং, প্রজাপতি, পাখিদের প্রতি অন্যরকম একটা অনুসন্ধিৎসু মন। প্রথম বর্ষে প্রথমবারের মতো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রজাপতি মেলা থেকে সংগৃহীত প্রফেসর ড. মনোয়ার হোসেন স্যারের বইগুলো ফড়িং ও প্রজাপতির প্রতি অন্যরকম এক আকর্ষণ তৈরী করে।
প্রথম বর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের টানা ৫০ দিনের ছুটিতে ফরিদপুরে অবস্থান করেছিলাম। প্রতিদিন সকাল বিকেল পুকুরপাড়ে, ঝোপঝাড়ে, বাহারি রঙের ফড়িং আর প্রজাপতি পর্যবেক্ষণ করতাম। দেখতাম এদের ছোটাছুটি। জমানো টাকা দিয়ে ছোট ডিজিটাল ক্যামেরায় তাদের শনাক্ত করার চেষ্টা। এরপর ৬ মাসের মাথায় দেখলাম আমার আশেপাশের এলাকা মিলিয়ে শুধু ফরিদপুর শহরের উপরই দেখা মিলছে ৩৪ প্রজাতির ফড়িং, ৫৬ প্রজাতির প্রজাপতির। আগ্রহ জন্মালো এই অঞ্চলের জীব বৈচিত্র্যের বর্তমান অবস্থা জানতে। পরিধি বাড়লো ঐ অঞ্চলের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটোছুটি, বা বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের।
গত সাত বছরের এই কাজগুলো থেকে বের হয়ে এসেছে নতুন নতুন অনেক তথ্য। বাংলাদেশের এই বায়োইকোলজিক্যাল অঞ্চলে এখন টিকে আছে ৬৫ প্রজাতির ফড়িং ও সূচ ফড়িং, ৮৭ প্রজাতির প্রজাপতি। এছাড়াও ৯২ প্রজাতির স্বাদু পানির মাছ, ২১ প্রজাতির ব্যাঙ, ৪২ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৬৭ প্রজাতির পাখি ও ৩১ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী।
লেপিডপ্টেরা (Lepidoptera) বর্গের অন্তর্ভুক্ত ৫টি পরিবারে ৮৭ প্রজাতির দেখা মিলেছিলো এই অঞ্চলে। যার মধ্যে লাইসিনিডি (ব্লুজ) এবং নিম্ফালিডি (ব্রাশ ফুটেট বাটারফ্লাই) এর সংখ্যাই বেশি। নয়ন (Peacock Pansy), চান্দরী (Grey Pansy), উসুম (Lemon Pansy), ধুপি (Dark Grass Blue), ছয় (Pale Grass Blue), কালিম (Common Mormon), বরুণ পাখা (Blue Mormon), রুরু (Lime Butterfly), রুপা পাটিয়া (Common Silverline), পায়রাছালি (Common Emigrant), ধূলকাপাস (Striped Albatross) এর সংখ্যা তূলনামূলক বেশি। এছাড়াও রয়েছে পরিযায়ী প্রজাতির বিচরণ; বিপন্ন প্রজাতির পরিযায়ী প্রজাপতি বিন্তি (Painted Lady) এর দেখা মেলে ফরিদপুরে। এছাড়া, তামট, সুষমা, বাঘাবাল্লার দেখা মেলে এই অঞ্চলে।
বিরল প্রজাতির প্রজাপতির মধ্যে রয়েছে – স্পটেট পামফ্লাই (বিপন্ন) (Spotted Palmfly); ডাবল ব্যান্ডেড জুডি(Double Banded Judy); টোয়া (সংকটাপন্ন) (Blue Pansy); খয়রা (বিপন্ন) (Palm Bob); ক্লাব সিলভার লাইন (সংকটাপন্ন) (Club Silverline); স্কার্স শট সিলভারলাইন (তথ্য সল্পতা) (Scarce Shot Silverline); পয়েন্টেড সিলিয়েট ব্লু (বিপন্ন) (Pointed Ciliate Blue)।
গ্রামীন পরিবেশ বিশেষ করে বুনো ঝোপঝাড়, পোষক গাছ সমৃদ্ধ এলাকায় বেশি দেখা মেলে এই প্রজাপতিদের। খাল, বিল, বাঁওড়, নদী, প্লাবনভূমি সমৃদ্ধ এলাকা এই গঙ্গা নিম্ন প্লাবনভূমি আর এখানে প্রাকৃতিক বনের পরিমাণ খুবই সামান্য। তাই গ্রামীন পরিবেশের বুনো ঝোপঝাড়, বাগান, বিল, বাওড় তীরবর্তী লতাগুল্ম গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল হিসাবে বিবেচিত এই প্রজাপতিদের জন্য। এছাড়া শহুরে সবুজ আচ্ছাদনগুলো প্রজাপতি ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু এখন দিন দিন কমছে এরকম প্রাকৃতিক পরিবেশ, পাশাপাশি নষ্ট হচ্ছে গুনগত মানও। শহরে সৌন্দর্যবর্ধনের নামে মানুষ ঝোপঝাড় বিনষ্ট করে রোপন করছে বিদেশি গাছ। যা এই প্রজাপতির জন্য বড় হুমকি।
ছোট একটি পতঙ্গ হলেও প্রজাপতি কিন্তু পরিবেশের এক গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক। ২০২১ সালে প্রকাশিত ঢাকা শহরের ওপর এক গবেষণায় দেখা যায়, পরিবেশের বিভিন্ন অজৈব নিয়ামকের উপর প্রজাপতির সংবেদনশীলতার গল্প। গঙ্গা নিম্ন প্লাবনভূমির অঞ্চলে প্রয়োজন এই প্রাণিটিকে রক্ষায় আরও সচেতনতা বৃদ্ধি। মানুষকে বোঝানো প্রয়োজন এদের গুরুত্ব। পাশাপাশি প্রত্যন্ত এলাকায় প্রয়োজন প্রজাপতি মেলার মতো আয়োজন যেন মানুষ আরও আগ্রহী হয় এই পতঙ্গ এবং এর আবাসস্থল সংরক্ষণে।