
প্রকৃতির অন্যতম সংবেদনশীল প্রাণের একটি হলো প্রজাপতি। এটি পরিবেশের ভারসাম্যের পরিমাপক। কোনো অঞ্চলে যত বেশি বৈচিত্রম্যয় প্রজাপতি, বুঝতে হবে সুস্থ আছে সেখানকার পরিবেশ। দক্ষিণ-এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে জীব-বৈচিত্র্যে ভরপুর বাংলাদেশ। কিন্তু মনুষ্যসৃষ্ট নানা কারণে বিলীন হচ্ছে এই বৈচিত্র্য। সম্প্রতি একটি গবেষণায় দেখা গেছে- দিন দিন এ দেশের শহরগুলোতে কমছে প্রকৃতির সুস্থতার নির্দেশক প্রজাপতিও।
অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রজাপতি নিয়ে পিএইচডি গবেষণা করছেন বাংলাদেশের গবেষক শাওন চৌধুরী। তার গবেষণায় উঠে এসেছে, ”পাঁচ বছর আগেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ও জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে প্রজাপতির যে বৈচিত্র্য দেখা যেত, তা এখন দেখা যায় না।” তবে এই কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ- অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও নগরায়ন। যা নষ্ট করছে প্রজাপতির আবাসস্থল এবং পোষকবৃক্ষ।
Lepidoptera/লেপিডোপ্টেরা বর্গের আবির্ভাব ঘটেছিল প্রায় ৪০ থেকে ৫০ মিলিয়ন বছর পূর্বে। এই বর্গের অধীনে আছে সাতটি পরিবার। প্রতি পরিবারেই ভিন্ন ধরণের প্রজাপতির দেখা মেলে। বিশ্বে সন্ধান মিলেছে প্রায় ১৯ হাজার প্রজাতির। এন্টার্কটিকা ছাড়া সব অঞ্চলে দেখা মেলে এই প্রাণীর। সব থেকে বেশি দেখা যায় নিও-ট্রপিকাল অঞ্চলে। খুবই স্বল্প আয়ুর প্রাণী প্রজাপতি (গড়ে ১৫ থেকে ৩০ দিন) জীবনকালে পার করে চারটি ধাপ।
পরিবেশের বিভিন্ন নিয়ামক যেমন: তাপমাত্রার হ্রাস-বৃদ্ধি দ্বারা প্রভাবিত হয় প্রজাপতি। এমনকি বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেও পাল্টে যাচ্ছে প্রজাপতি পরিযানের গতিপথ। আরেকটি কারণ বড় শহরগুলোতে অতিরিক্ত দূষণসহ আবহাওয়াগত তারতম্যের কমছে এই প্রাণীর সংখ্যা।
গবেষণাপত্রে বলা হয়, বাংলাদেশের মোট প্রজাপতির ৪৫ শতাংশ অর্থ্যাৎ ১৩৭ প্রজাতি দেখা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রমনাপার্ক ও জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে। এর ৪০ শতাংশ এখন বিপদাপন্ন। গেল তিন বছরে ক্রমান্বয়ে কমেছে প্রজাতি বৈচিত্র্যও।
বুনো পরিবেশে প্রজাপতির জন্য সহায়ক লতাপাতা ও গাছপালা খুব কমই দেখা যায়। বিশেষ করে নগরায়নের ফলে তা একেবারেই নেই অনেক শহরের অনেক এলাকায়। এখন তো প্রত্যক্ষভাবে অর্থনৈতিকভাবে উপকারি গাছ ছাড়া অন্য গাছ রোপণও হয় না। ফলে অনেক প্রজাপতি হারাচ্ছে পোষক উদ্ভিদ। এতে শহর থেকেও হারিয়ে যাচ্ছে প্রজাপতি। আবার কিছু পোষাক গাছের অধিক্যের কারণে বা মনো কালচারের কারণে বৃদ্ধি পাচ্ছে নির্দিষ্ট কিছু প্রজাতির সংখ্যা।
শাওন চৌধুরীর আরেকটি গবেষণায় উল্লেখ করা হয়- বাংলাদেশে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের পরিমাণ দেশের মোট আয়াতনের চার দশমিক একষট্টি শতাংশ। কিন্তু থাকার কথা ছিল ১৭ শতাংশ। প্রয়োজনের তুলনায় যা একেবারেই কম। এই সংরক্ষিত এলাকার বাইরে বসবাস অধিকাংশ প্রজাপতির। গবেষণায় মডেলিং করা হয়েছিল এ দেশে প্রাপ্ত ২৪৬টি প্রজাতির প্রজাপতির বিস্তৃতির ওপর। গবেষণাপত্র প্রমাণ করে- সংরক্ষিত এলাকার বাহিরে প্রজাপতি ও তার আবাসস্থল সংরক্ষণ কতটা গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে তো অবশ্যই।
২০১৫ সালে বাংলাদেশে প্রজাপতির মধ্যে ৩০৫টি প্রজাপতির তথ্য উপাত্ত মূল্যায়ন করে প্রাণ-প্রকৃতি সংরক্ষণে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা- আইইউসিএন। প্রতি বছর নতুন প্রজাতির তথ্য যুক্ত হচ্ছে এ দেশে। ভূ-প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক অবস্থা বিচার করে বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বাংলাদেশে প্রজাতির সংখ্যা পাঁচশোর বেশি হতে পারে প্রজাপতি।
উদ্ভিদের পরাগায়নের অন্যতম মাধ্যম হিসাবে ও খাদ্যশৃঙ্খলে (পাখি ও পতঙ্গভূক প্রাণিদের) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে প্রজাপতিরা। একটি পরিবেশ কতটা সুস্থ তা নির্দেশ করে প্রজাপতির উপস্থিতি ও স্বতস্ফুর্ত বিচরণ। কিন্তু শহুরে পরিবেশে প্রজাপতির বৈচিত্র্যতা কমে যাওয়া দিচ্ছে অশনি সংকেত- মানুষের বসবাসের পরিবেশ কতটা ঝুঁকিতে!
বাস্তুতন্ত্রে প্রতিটি প্রাণী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অগোচরে হারিয়ে যাচ্ছে প্রজাপতির মতো নানা ছোট-বড় প্রাণী, যা হয়তো হিসেবের খাতার বাহিরে। তবে নগরায়ন যেমন জরুরি তেমনি মানুষকে টিকে থাকতে দরকার সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশ। এজন্য প্রয়োজন দেশিয় বৈচিত্র্যময় গাছ-গাছালী। আবাসিক, সরকারি বা সংরক্ষিত এলাকাগুলোতে সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রজাপতির পোষক উদ্ভিদ সংরক্ষণ ও রোপণ করা জরুরি।