
বাংলাদেশের দেশিয় বা আবাসিক পাখিদের এখন প্রজনন মৌসুম চলছে। মার্চ থেকে সেপ্টম্বর মাস পর্যন্ত বিভিন্ন গোত্রীয় ও পরিবারভুক্ত পাখিদের প্রজননকাল। এই সময়ের মধ্যে পাখিদের জোড়া বাঁধার আকাঙ্খা, ঘর বাঁধার স্বপ্ন, প্রেম বিনিময় খুবই লক্ষ্যণীয় একটি ঘটনা। যারা পাখি নিয়ে কাজ করেন ও ছবি তুলেন একমাত্রই তারাই পাখিদের প্রেম বিনিময়ের কৌশলগুলি পর্যবেক্ষণ করে থাকেন। আমি পাখিদের এই সময়টা খুব উপভোগ করি।
বাংলাদেশে পাঁচ প্রজাতির বসন্ত বাউরি পাখি দেখা যায়। এরা সবাই মেগালাইমিডে পরিবারের অন্তর্ভুক্ত এবং সিলোপোগন গোত্রীয়। শুধুমাত্র লাইনিয়েটেড বারবেট বা রেখা বসন্ত বৌরি মেগালাইমিডে গোত্রীয়। এই সবগুলো পরিবারের বসন্ত বৌরির এখন প্রজনন মৌসুম। এরা এ দেশে খুবই সর্বজনীন পাখি। এ দেশের সব জেলা ও গ্রাম-গঞ্জে সহজেই দেখা যায় এদের। গ্রামের মেঠো পথ ধরে হাঁটলেই বসন্ত বৌরির হাতুড়ি পিটা ডাক শুনলেই বুঝা যায়, সময় হয়েছে বসন্ত বৌরির ঘর বাঁধার।
সাতছড়ি বনের ভেতর একটি বটকল গাছে খুব ভোরে আমি এবারই প্রথম দেশিয় চার প্রজাতির বসন্ত বৌরি পাখির বিচরণ দেখলাম। গ্রেট বারবেট বা বৃহৎ বসন্ত বৌরি ছাড়া বাকি পাখিদের ছবি বহু বছর আগে তোলা ছিলো। একসঙ্গে চার প্রজাতি বসন্ত বৌরি পখির একই গাছে দেখা যাবে এটা ছিলো আমার কল্পনার বাহিরে। অথচ এই চার প্রজাতি পাখির ছবি তুলতে আমাকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়েছিল। সেই সময় এদের ছবি ফ্রেমবন্দি করতে পারলেও তেমন পরিবেশ পাইনি। এবার একই গাছে এক সঙ্গে পাখিগুলোকে দারুণ এক অপূর্ব পরিবেশ ধারণ করতে পারায় নিজেকে ভাগ্যবান মনে হলো।
সাধারণত একা বা জোড়ায় দেখা যায় বসন্ত বৌরি। মাঝে মধ্যে এরা অন্যান্য ফলহারী পাখির মিশ্র দলেও থাকতে পছন্দ করে। এরা ফলদ গাছ থেকে খাবার সংগ্রহ করে। খাদ্য তালিকায় রয়েছে ফল ও অন্যান্য পোকা। প্রজননের জন্য পুরুষপাখি কুটুরুক.. কুটুরুক.. শব্দে দীর্ঘক্ষণ ধরে ডাকে। প্রজননকালে বিরতিহীনভাবে মহিলা পাখিরা সারাদিনই ডাকতে থাকে। এদের ডাকে পুরুষ পাখিরা ডাকের প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়।
এক নজরে বসন্ত বৌরি
বসন্ত বৌরি সবুজ বর্ণের ক্ষুদে বৃক্ষচারী পাখি। আকার ভেদে ছোট বসন্ত বৌরি ১৭ সেন্টিমিটার (সে:মি) দৈর্ঘ্যের ও ৪০ গ্রাম ওজনের। রেখা বসন্ত বৌরি ২৮ সে:মি এবং ১৫৫ গ্রাম ওজনের। সুবজাভ বা নীলকান বসন্ত বৌরি ১৮ সে:মি ও ৩৫ গ্রাম ওজনের এবং বড় বসন্ত বৌরি ২৪-২৫ সে:মি ও ৮০ গ্রাম ওজনের হয়ে থাকে।
মার্চ থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত এদের প্রজননকাল। প্রজননকালে নিজেরাই পরিত্যাক্ত কোন গাছের গর্তে বাসা বানায়। নিজেদের বানানো বাসায় মা পাখিরা ৩-৫টি ডিম পাড়ে। উভয়েই ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফুঁটায়। নিজেরাই করে সংসারের যাবতীয় কাজ।
বসন্ত বৌরি পাখি বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, ভূটান ও পাকিস্তানে দেখা যায়। এরা বাংলাদেশে বিপদমুক্ত বলে বিবেচিত। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে সংরক্ষিত পাখি এটি। বাংলা নাম- ছোট বসন্ত বৌরি/বড় বসন্ত বৌরি/ সুবাজাভ বা নীলকান বসন্ত বৌরি ও রেখা বসন্ত বৌরি। ইংরেজি নাম- Coppersmith Barbet/Blue-eared Barbet/Lineated Barbet & Blue-Throated Barbet।
লেখক: বন্যপ্রাণী বিষয়ক আলোকচিত্রী, বাংলাদেশ।