চিত্রা হরিণ, চিত্রল হরিণ বা চিত্র মৃগ, যে যেই নামেই ডাকুক না কেন হরিণের এই প্রজাতিটি যে সবচেয়ে সুন্দর ও আকর্ষণীয় এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। ভারতীয় উপমহাদেশে মায়া হরিণ, সাম্বার, বারশিঙ্গা ও বল্গা হরিণের মত হরেক রকমের প্রজাতির দেখা মিললেও দেহের রঙ চিত্রা হরিণকে করেছে অতুলনীয়। যে কোন বনে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে চিত্রা হরিণ। কিন্তু বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী হিসেবে চিত্রা হরিণ এখন অস্তিত্ব সংকটে বলছেন প্রাণীবিদরা।
গবেষকদের মতে, একসময় চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, দিনাজপুরের শালবন, টাঙ্গাইলের মধুপুরগড় ও ময়মনসিংহে অহরহ দেখা মিলতো চিত্রা হরিণ। কিন্তু এসব অঞ্চলে প্রাণীটির প্রায় বিলুপ্তি ঘটেছে। এখন সুন্দরবনই হরিণটির প্রধান আবাসস্থল। শিকার-পাচার ও বনাঞ্চল ধ্বংসের কারণে হরিণটির সংখ্যা আশংকাজনক হারে কমছে সুন্দরবনে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও প্রাণীবিদ গাজী আসমত বলেন, “বন্যপ্রাণী হিসেবে চিত্রা হরিণের অস্তিত্ব হুমকির মুখে। বড় কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে সুন্দরবন উপকূলীয় অঞ্চলের চিত্রা হরিণ পুরোপুরি বিলীন হয়ে যাওয়াও অস্বাভাবিক না।”
১৯৭৪ ও ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী আইন উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী আইনের অস্তিত্ব কাগজে কলমে থাকলেও বাস্তবতা ভিন্ন। শুধু আইন করে বন্যপ্রাণী রক্ষা করা সম্ভব নয়, যতদিন না আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ এবং জনমনে সচেতনতা বাড়বে।”
বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী পাচার-শিকার রোধ ও সংরক্ষণে কাজ করছে বনবিভাগের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট। গেল দু’চার বছরে হরিণ পাচার ও শিকারের বিষয়ে তেমন কোন অভিযোগ আসেনি বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির পরিচালক জহির উদ্দিন আকন।
তিনি বলেন, “হরিণ সরাসরি পাচার বা স্থানান্তর সাধারণত হয় না, তবে হরিণ শিকার করে সুন্দরবন উপকূলীয় অঞ্চলের মাংস বিক্রি হয়। এ ব্যাপারে বনবিভাগ কোস্টগার্ডের সহায়তায় আইনী পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। তবে সামগ্রিক ভাবে চিন্তা করলে হরিণ শিকার বিগত কয়েক বছরে বেশ কমে এসেছে।”
“বন্যপ্রাণী রক্ষার বিষয়টি সহজ করার জন্য আমরা দুটি পদক্ষেপ নিয়েছি। প্রথমত, গণসচেতনতা বাড়ানোর জন্য অনলাইন এবং অফলাইনে ব্যাপকভাবে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ৯৯৯ হটলাইন নাম্বারে আমরা সংযুক্ত হয়েছি যাতে দেশের যেকোন প্রান্ত থেকে বন্যপ্রাণী উদ্ধার ও রক্ষাসংক্রান্ত যে কোন জটিলতায় দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারি,” যোগ করেন জহির উদ্দিন আকন। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দিনে গড়ে তিনশো’রও বেশি ফোন পান বলেও জানান তিনি।
উদ্ধার করা বন্যপ্রাণী বনবিভাগ সাফারি পার্কে অবমুক্ত করার বিষয়টির সমালোচনা করেন প্রাণীবিদ ড. গাজী আসমত। “মাঝে মধ্যেই আমরা লোকালয়ে হরিণ ধরা পড়ার খবর পাই, পরে যেগুলোর ঠাঁই হয় সাফারি পার্কগুলোতে। কিন্তু বন্যপ্রাণীর অধিকার রয়েছে বুনো পরিবেশে নিজের মত করে বাঁচার। তাই উদ্ধার করা হরিণগুলোকে বনাঞ্চলে ছেড়ে দিয়ে এদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব,” যোগ করেন তিনি।
বন্যপ্রাণী উদ্ধার ও অবমুক্ত করা প্রসঙ্গে বন কর্মকর্তা জহির উদ্দিন আকন বলেন, “যে কোন প্রাণী উদ্ধারের পর প্রয়োজন অনুযায়ী বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে আমরা সেগুলোকে সাফারী পার্ক কিংবা বনে অবমুক্ত করে থাকি।”
যদিও বাংলাদেশের সার্বিক প্রেক্ষাপটে আশার কথা হচ্ছে খুব ধীরগতিতে হলেও বর্তমানে জনমনে সচেতনতা বাড়ছে। এতে বেড়েছে বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র রক্ষার তাগিদও। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সচেতনতার কাজটি অনেকটা সহজ করে দিয়েছে বলেও মনে করেন বন্যপ্রাণী গবেকরা। ১৯৮০ সালে নিঝুম দ্বীপে কয়েক জোড়া চিত্রা হরিণ ছেড়ে দেয়া হয়। বর্তমানে সেখানে চিত্রা হরিণের উল্লেখযোগ্য হারে রয়েছে দ্বীপটিতে।
সুন্দরবনের সবচেয়ে সুন্দর প্রাণীটিকে বিলুপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা করতে সচেতনতা, আইনের প্রয়োগ ও প্রকৃতির উপর মানুষের প্রেম ও দায়বদ্ধতা প্রয়োজন বলছেন প্রাণীবিদরা। এতে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রকৃতি থেকে বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীগুলো রক্ষা করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন তারা।
চিত্রা হরিণ
ইংরেজী নাম “Chital” যা কিনা বাংলা “চিত্রা বা চিত্রল” থেকে এসেছে যার অর্থ ফোঁটা বা ছাপযুক্ত। বাদামী চামড়ার উপর সাদা সাদা ছোপগুলো এই হরিণের সৌন্দর্যে যোগ করেছে ভিন্ন মাত্রা, যেন কোন শিল্পী বাদামী ক্যানভাসে নিপুণ হাতে সাদার মায়া মিশিয়ে তৈরি করেছেন এক আশ্চর্য শিল্পকর্ম।
চিত্রা হরিণের প্রধান খাদ্য ঘাস ও ছোট জাতের উদ্ভিদ। অনেক সময় বানর বা হনুমানের ফেলে যাওয়া গাছের পাতা কিংবা বাকল খেয়েও জীবন ধারণ করে হরিণ প্রজাতিটি। কখনো নিজেদের পড়ে যাওয়া শিংও খায় এরা। এই হরিণ একবার পরিচিত হয়ে গেলে মানুষের প্রতি বন্ধুসুলভ আচরণ করে। মানুষের দেয়া বাধাকপি, বরবটি কিংবা শিমের মত সবজিও খেয়ে থাকে হরিণটি।