ব্যাঙ প্রজননে যত বাধা

ছায়াঘেরা ও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ ব্যাঙের জন্য আদর্শ স্থান। গাছের নিচে জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে ব্যাঙে ডিম পাড়ে। কিন্তু রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে গাছ কমে যাওয়ায় ব্যাঙের প্রজননের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। অথচ ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত রোগের বিস্তার রোধে ব্যাঙের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ব্যাঙ মানুষের উপকার করে। মশার লার্ভাসহ পোকামাকড় খেয়ে ব্যাঙ প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে।

গবেষকরা বলছেন, ব্যাঙসহ বিপন্ন প্রাণীদের সংরক্ষণ করা না হলে প্রকৃতির ভারসাম্য ভেঙে পড়বে। তাই ব্যাঙকে পড়শি বলা হয়। অথচ দিনের পর দিন নির্বিচারে ব্যাঙ হত্যা ও ব্যাঙের পরিবেশ নষ্ট করা হচ্ছে। প্রকাশ্য ও চোরাগুপ্তা শিকারিদের দৌরাত্ম্যে ব্যাঙ নিধন করা হচ্ছে। বাসস্থান ও জলাভূমি কমে যাওয়ায় প্রাণীটি বেশি বিপন্ন হয়ে পড়ছে। বিপন্ন প্রাণী ব্যাঙ রক্ষায় কারও উদ্যোগ নেই।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক বিজ্ঞানী ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, ব্যাঙ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। সরকার ব্যাঙ রপ্তানি বন্ধ করেছে। প্রাণীটি রক্ষায় সাধারণ মানুষকে সচেতন হতে হবে। জলাভূমি কমে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়া, কৃষিজমিতে কীটনাশক ব্যবহার, জলবায়ু পরিবর্তন, খাওয়ার জন্য ব্যাঙ শিকার ইত্যাদি কারণে দেশে বিভিন্ন প্রজাতির ব্যাঙ বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে।

পৃথিবীতে ৭ হাজার ৬০৩ প্রজাতির ব্যাঙ রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াইল্ডলাইফ রিসার্চ ল্যাবরেটরির একটি গবেষণা বলছে, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে ৬৩ প্রজাতির ব্যাঙ দেখা গেছে। এই গবেষণায় ব্যাঙের ওপর প্রায় ১৫০ প্রকাশিত গবেষণাপত্র পর্যালেচনা করা হয়েছিল।

গত ৫০ বছরের বিভিন্ন গবেষণা দেখা গেছে, বাংলাদেশে ব্যাঙের প্রজাতিগত সংখ্যা ৬৩টি। গত ১২ বছরে বাংলাদেশ মোট ২৪টি নতুন ব্যাঙের সন্ধান মিলেছে, যার মধ্যে ৯টি ব্যাঙই পৃথিবীর জন্য নতুন ছিল। ২০১৫ সালে আইইউসিএন বাংলাদেশ জানায়, বাংলাদেশের ৪৯ প্রজাতির উভচরের মধ্যে ৯ প্রজাতির ব্যাঙ বিলুপ্তির ঝুঁকির কারণে লাল তালিকার্ভুক্ত করা হয়েছে। ৯ ব্যাঙের ৬টি এবং নতুন আবিষ্কৃত ২৪টি ব্যাঙের মধ্যে ৯টিই সংরক্ষিত এলাকার বাইরে পাওয়া গেছে।

ব্যাঙ কেন প্রয়োজন?
ব্যাঙ নিজ শরীরের দ্বিগুণ পোকামাকড় খেতে পারে। ফলে ফসলের খেতে থাকা ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে কৃষকের উপকার করে ব্যাঙ। এতে আর্থিকভাবেও লাভবান হয় কৃষক। কারণ অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না। এই কারণে ফসলের গুণগত মান ও মাটির গুনাগুণ ঠিক থাকে। যা প্রাকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখে। আবার ব্যাঙের মূত্রে ইউরিয়া-জাতীয় পদার্থ থাকে যা জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করে এবং ফসলের উৎপাদন তরান্বিত করে। এক জরিপে দেখা গেছে, একটি ব্যাঙ নিজের পুরো জীবনে প্রায় চার লাখ টাকার ফসল রক্ষা করে।

কৃষি ও অর্থনৈতিক উপকারের পাশাপাশি ডেঙ্গু, চিকনগুনিয়াসহ বিভিন্ন মশাবাহিত রোগের বাহক মশার লার্ভা ব্যাঙাচি অবস্থায় খেয়ে থাকে ব্যাঙ। যা মশা দমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান শিল্পায়ন, নগরায়নের ফলে তাদের আবাসস্থল নষ্ট হচ্ছে। তেমনি নষ্ট হচ্ছে ব্যাঙের প্রজনন ক্ষেত্রও। ফলে দিন দিন কমছে ব্যাঙের সংখ্যা। যা মানবজাতির জন্যও ক্ষতিকর। কোন এলাকায় ব্যাঙের উপস্থিতি নির্দেশ করে সেখানকার পরিবেশ কতটা সুস্থ।

এদিকে দিনের পর দিন নির্বিচারে ব্যাঙ হত্যা ও ব্যাঙের পরিবেশ নষ্ট করা হচ্ছে। প্রকাশ্য ও চোরাগুপ্তা শিকারিদের দৌরাত্ম্যে ব্যাঙ নিধন করা হচ্ছে। বাসস্থান ও জলাভূমি কমে যাওয়ায় প্রাণীটি বেশি বিপন্ন হয়ে পড়ছে। বিপন্ন প্রাণী ব্যাঙ রক্ষায় কারও উদ্যোগ নেই।

গবেষকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে প্রকৃতির গা ঘেঁষে থাকা প্রাণী ব্যাঙ অস্তিত্বসংকটে। এখন খাল-বিল, জলাশয়ে ব্যাঙের দেখা মেলে না। শুধু ব্যাঙই নয়, স্যালামান্ডার, সিসিলিয়ানের মতো উভচর প্রাণীর সংখ্যা ভয়াবহ হারে কমছে। নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি গবেষণায় উঠে আসে- ব্যাঙসহ প্রকৃতির গা ঘেঁষে থাকা প্রাণীগুলো কমে যাচ্ছে। অবিলম্বে এমন বিপন্ন প্রাণীদের সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। না হলে শিগগিরই প্রকৃতির ভারসাম্য ভেঙে পড়বে।

জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ব্যাঙ প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা তথা মশাবাহিত রোগ বিস্তার প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা রাখে। একটিমাত্র ব্যাঙ হাজার হাজার মশা ও লার্ভা খেয়ে ধ্বংস করে। দেশে ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত রোগের প্রকোপ বাড়ছে। পর্যাপ্ত ব্যাঙ থাকলে মশার এতো বিস্তার হতো না। প্রাণীটির বাসস্থানসহ জলাশয় দিন দিন ধ্বংস করা হচ্ছে। প্রকাশ্যে ব্যাঙ নিধন করা হচ্ছে। ব্যাঙ রক্ষায় কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। শুধু ওষুধ ছিটিয়ে মশা ও মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধ রোধ করা সম্ভব নয়।