অবশেষে প্রাণীদের অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্রাণীবান্ধব করা হচ্ছে ৫০ বছরের পুরনো বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত জাতীয় চিড়িয়াখানাকে। এতে ছোট্ট খাঁচায় প্রাণীদের বন্দি রেখে বিনোদনের প্রচলিত ব্যবস্থাপনা বন্ধ করা হবে বলছে কর্তৃপক্ষ। এজন্য নতুন একটি মহাপরিকল্পনার আওতায় প্রাণিবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা হবে চিড়িয়াখানাকে। মূলত এতদিন প্রাণী অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত হচ্ছে বলে প্রাণিপ্রেমীদের যে অভিযোগগুলো ছিল তা আমলেই চিড়িয়াখানার এই সংশোধন বলছে কর্তৃপক্ষ।
২০১৮ সালের আগস্টে ঢাকা ও রংপুর চিড়িয়াখানার মহাপরিকল্পনা তৈরিতে প্রকল্প হাতে নেয় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। ৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্প সম্পন্নের সময় ধরা হয় ২০২০ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত। মাস্টাপ্ল্যান তৈরির কাজ দেয়া হয় সিঙ্গাপুরভিত্তিক প্রতিষ্ঠান বার্নার্ড হ্যারিসন অ্যান্ড ফ্রেন্ডস লিমিটেডকে। নির্ধারিত সময়ের ১৬ মাস পর দুই চিড়িয়াখানার মাস্টারপ্ল্যানের খসড়া তৈরি করেছে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান।
গেল ১৪-১৫ অক্টোবর দুদিনের এক কর্মশালার মাধ্যমে ঢাকা ও রংপুর চিড়িয়াখানার জন্য তৈরি মহাপরিকল্পনা তুলে ধরে বার্নার্ড হ্যারিসন অ্যান্ড ফ্রেন্ডস লিমিটেড। মহাপরিকল্পনায় দশ ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে পুরো চিড়িয়াখানাকে।
জাতীয় চিড়িয়াখানার পরিচালক ডা. আব্দুল লতিফ জানিয়েছেন, নতুন পরিকল্পনায় পুরো চিড়িয়াখানাকে প্রাণিবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। এখানে প্রাণি ও মানুষের মাঝে প্রাকৃতিক খাঁচা থাকবে। যা দেখে দর্শনার্থীরা মনে হবে উন্মুক্ত অবস্থায় আছে প্রাণীরা।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের জাতীয় চিড়িয়াখানা সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ একটি প্রতিষ্ঠান। ১৯৬৪ সালে জায়গা অধিগ্রহণের পর মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বন্ধ থাকলেও স্বাধীনতার পরবর্তী ১৯৭৪ সালের ২৩ জুন চিড়িয়াখানাটি উদ্বোধন ও সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করেন জাতিজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ জানায়, আগামী ডিসেম্বরে মহাপরিকল্পনা অনুমোদন হলেই শুরু হবে উন্নয়ন কাজ। যা শেষ হতে সময় লাগবে অন্তত ছয় বছর। পরিকল্পনা অনুযায়ী পুরো চিড়িয়াখানার আধুনিকায়নে প্রায় ১৩শ’ কোটি টাকা ব্যয় হতে পারে বলে জানিয়েছে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ।
পরিকল্পনা প্রণয়নকারী দলের সদস্য ড. রেজা খান বলেন, এই মহাপরিকল্পনা এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে এটি বাস্তবায়ন হলে চিড়িয়াখানার কোনো অংশে গেলে মনে হবে সুন্দরবনে আছি, কোনো অংশকে মনে হবে আফ্রিকার ওকাভাঙ্গো ব-দ্বীপ। আগতরা একেক সময় একেক অনুভূতি পাবেন। পুরো পরিকল্পনায় কোথাও বিদেশি উদ্ভিদের বনায়নের সুযোগ রাখা হয়নি বলেও জানান তিনি।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, এ দেশের সকল প্রতিষ্ঠানকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করার লক্ষ্য হিসেবে জাতীয় চিড়িয়াখানা এবং রংপুর চিড়িয়াখানার এই মহাপরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানা ও রংপুর চিড়িয়াখানা বিশ্বমানে রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় রয়েছি। পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন হলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষ এই প্রাণীবান্ধব এই চিড়িয়াখানা পরিদর্শনে বাংলাদেশে আসবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
মহাপরিকল্পনা খসড়ায় যা রয়েছে:
৭৬ দশমিক ৯ হেক্টর ভূমির মালিক মিরপুর জাতীয় চিড়িয়াখানায় স্থান পাবে ২২৩ প্রজাতির প্রাণী। এরমধ্যে অঞ্চল ভেদে থাকবে ১০২ দেশীয় প্রজাতি, ৬৬টি প্রজাতির ট্রফিকাল (গ্রিষ্মমণ্ডলীয়), ৪০ প্রজাতি আফ্রিকান এবং ১৫ প্রজাতির নিশাচর প্রাণী। এসব প্রাণিদের খাঁচায় রাখলেও দর্শনার্থীরা দেখবেন না খাঁচার আবয়ব। ফলে মনে হবে পুরোপুরি উন্মুক্ত রয়েছে প্রাণিরা। মিরপুর এবং বেড়িবাধের দুটি ফটক দিয়ে প্রবেশের পাশাপাশি নৌকা এবং বিশেষ গাড়িতে ঘুরে প্রাণী দেখার সুযোগ থাকবে। তবে কর্তৃপক্ষ এই মহাপরিকল্পনাকে প্রাণিবান্ধব বলে উল্লেখ করলেও কোন প্রাণীর বিচরণ এলাকার পরিমাণ কতটুকু হবে তা প্রকাশ করেনি খসড়া পরিকল্পনায়।
চিড়িয়াখানা বাংলাদেশের পরিবেশে বিচরণকারী প্রাণীদের জন্য নির্ধারিত স্থানের নাম হবে বাংলাদেশ হেবিটেড। এখানে ১০২ প্রজাতির দেশীয় প্রাণীর জন্য ভূমি রাখা হয়েছে ১৭.৬৮ হেক্টর। দেশীয় প্রাণিদের জন্য নির্ধারিত এলাকাকে সাজানো হবে সুন্দরবনের মতো ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের আদলে। জলাভূমির মাঝে থাকবে বিভিন্ন প্রাণীর আবাসস্থল। ২১টি খাঁচায় থাকবে একটি অমেরুদণ্ডী, ২৬ প্রজাতির মাছ, ৯ প্রজাতির সরীসৃপ, ৫৪ প্রজাতির পাখি এবং ১২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রজাতির প্রাণী।
গ্রিষ্মমণ্ডলীয় এলাকায় বিচরণকারী প্রাণিদের জন্য নির্ধারিত এলাকার নাম হবে ট্রফিক্যাল হেবিটেড। এতে ৬৬ প্রজাতির প্রাণীর জন্য গ্রিষ্মমণ্ডলীয় বন অর্থাৎ চিরসবুজ এবং শাল বলেন আদলে সাজানো হবে ১৪ দশমিক ৪৮ হেক্টর। এতে ২৬টি খাঁচায় ৭টি প্রজাতির সরীসৃপ, ৪৫টি প্রজাতির পাখি এবং স্তন্যপায়ী প্রাণী থাকবে ১৪ প্রজাতির।
আফ্রিকার পরিবেশে বিচরণকারী প্রাণিদের জন্য নির্ধারিত স্থানের নাম হবে আফ্রিকান হেবিটেড। সর্বোচ্চ ভূমি বরাদ্দ রাখা হয়েছে এই অংশের জন্য। যা সাজানো হবে আফ্রিকার ওকাভাঙ্গো অঞ্চলের আদলে। এতে ২৩.১৬ হেক্টর এলাকায় ২০টি খাঁচায় রাখা হবে ৪০ প্রজাতির প্রাণী। যারমধ্যে থাকবে তিন প্রজাতির সরীসৃপ, ১৬টি প্রজাতির পাখি এবং ২১টি প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী।
অপরদিকে নিশাচর প্রাণিদের জন্য রাখা হচ্ছে আলাদা এলাকা। যার নাম হবে নকটার্নাল হেবিটেড। তাদের জন্য ঘন জঙ্গলের আদলে গড়ে তোলা হবে ৩.৭৫ হেক্টর এলাকা। যাতে ১৫টি খাঁচায় থাকবে ১৫ প্রজাতির প্রাণী। এর মধ্যে রাখা হবে দুই প্রজাতির সরীসৃপ, এক প্রজাতির পাখি এবং ১২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী।
শিশুদের বিনোদন, অ্যাডভেঞ্চার এবং শিক্ষামূলক প্রদর্শনীর জন্য থাকবে ৫.৩৮ হেক্টর এলাকা। এটির নাম হবে একটিভ জোন। এতে ১০টি খাঁচায় রাখা হবে চার প্রজাতির পাখি এবং ছয় প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী।
জাতীয় চিড়িয়াখানায় আলাদাভাবে ৩.৪৮ হেক্টর এলাকায় জলাভূমি তৈরি, ১.১ হেক্টর এলাকায় নার্সারি, প্রধান প্রবেশ পথের জন্য মিরপুর-১ অংশে ১.৭৭ হেক্টর, দ্বিতীয় প্রবেশপথের জন্য মিরপুর বেড়িবাধের অংশে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১.৭৭ হেক্টর ভূমি। বের হওয়ার পথ এবং পার্কিং মিলিয়ে রাখা হয়েছে আরো ৪.৭ হেক্টর এলাকা।