বাংলাদেশের বান্দরবান জেলার লামা উপজেলার একটি আশ্রম থেকে বিলুপ্তপ্রায় এশিয়ান কালো ভাল্লুকের শাবক উদ্ধার করেছে বনবিভাগ। ২৪ জুন, বুধবার উপজেলারটির ইয়াংছা মৌজার জিনামেজু আশ্রম থেকে ভাল্লুক শাবকটি উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানায় বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট।
বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক জহির উদ্দিন আকন বেঙ্গল ডিসকাভার-কে বলেন, ”গত পাঁচদিন আগে দলছুট হয়ে কুকুরের তাড়া খেয়ে গাছে উঠে পড়ে এশিয়ান কালো ভাল্লুক শাবকটি। পরবর্তীতে সেখান থেকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে আশ্রমে রাখে। আশ্রম কর্তৃপক্ষ বিষয়টি বনবিভাগকে জানালে লামা বনবিভাগের কর্মকর্তারা উদ্ধার করে। এটিকে সংরক্ষণের জন্য চকরিয়ার ডুলাহাজরা সাফারি পার্কে রাখা হবে।”
জানা গেছে, বান্দরবানের পাহাড়ি বনাঞ্চলে এক সময় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ছিল এশিয়ান কালো ভাল্লুক। কিন্তু আবাস ও খাদ্য সংকট এবং শিকার ও পাচারের কারণে এ দেশের পাহাড়ি অঞ্চলে ভাল্লুকের এ প্রজাতিটি দেখা মেলা ভাড়। এখনো যে অল্প কিছু টিকে আছে তাও শিকারিদের কারণে হুমকির মুখে।
প্রাণীবিদরা জানান, বাসস্থান ধ্বংস, চামড়া, লোম, পিত্ত থলি, দাঁত ও নখের জন্য ভাল্লুক শিকার করা হয়। এ কারণে এশিয়ান কালো ভাল্লুক বাংলাদেশর বন থেকে বিলুপ্তির মুখে। দ্রুত এদের সংরক্ষণে পদক্ষেপ না নিলে এ দেশ থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে প্রাণীটি। কালো ভাল্লুক (Asian black bear) সংকটাপন্ন প্রজাতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশে কালো ভাল্লুক মহাবিপন্ন প্রজাতি হিসেবে বিবেচিত এবং ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত।
বন্যপ্রাণী গবেষক আদনান আজাদ আসিফ বেঙ্গল ডিসকাভার-কে বলেন, এটি বাংলাদেশের মহাবিপন্ন প্রজাতির প্রাণী, এরা সর্বভুক্ত মানে মাংস থেকে ফল পাতা সব খায়। বাচ্চা বড় না হওয়া পযন্ত মায়ের সাথেই থাকে। মা সকল বিপদ থেকে বাচ্চাকে লড়াই করে রক্ষা করে। এমন কি বাচ্চার আশেপাশে কয়েকশত গজের ভেতরে কোনো মানুষ প্রবেশ করলে মা তাদেরও আক্রমণ করে বাচ্চাকে রক্ষায়।
”যদি ভাল্লুকের শাবকটি সুস্থ থাকে তবে এটিকে পুনরায় একই এলাকার বনাঞ্চলে অবমুক্ত করলে প্রাণীটির জন্যই ভাল হবে। কারণ এরা টেরিটোরিয়াল প্রাণী, ওর মা ঠিকই খুজে নিতে পারবে শাবকটিকে,” উল্লেখ করেন গবেষক আদনান আজাদ আসিফ।
তিনি জানান, ”সাফারি পার্কের এলাকা সংলগ্ন বনাঞ্চলে যদি ছাড়া হয় আর সেখানে যদি অন্য প্রাপ্তবয়স্ক কোনো ভাল্লুকের টেরিটরি থেকে থাকে তাহলে বাচ্চাটিকে মেরে ফেলতে পারে। তাই মহাবিপন্ন প্রাণীটিকে রক্ষায় এটির ভবিষ্যতের বিষয়টিও চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
বাংলাদেশের পাহাড়ি বনে কতটি কালো ভাল্লুক টিকে আছে এর সঠিক কোন তথ্য নেই। তাই ভাল্লুক শুমারী করে প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণ করে প্রাণীটিকে সংরক্ষণ ও নিরাপদ রাখতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে পরামর্শ দিয়েছেন প্রাণীবিদরা।
ভাল্লুক নিয়ে আরো তথ্য
ভাল্লুক শ্বাপদ বর্গের (order carnivora) স্তন্যপায়ী প্রাণী। পৃথিবিতে আট প্রজাতির ভাল্লুক রয়েছে। ভাল্লুকের চেহারা ভারী এবং পা ছোট আর মোটা হয় এবং মুখ লম্বাটে, গায়ে বড় বড় লোম। ভাল্লুকের থাবায় পাঁচটি আঙ্গুল আর আঙ্গুলে নখ থাকে। তবে সব ভাল্লুকের গায়ের রঙ একরকম নয়। যেমন আমেরিকান কৃষ্ণ ভাল্লুকের গায়ের রঙ কালো, বাদামি, নীলাভ কালো ইত্যাদি হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে দুটি প্রজাতির ভাল্লুক দেখা যায়। এরমধ্যে একটি এশিয়ান কালো ভাল্লুক ও অপরটি সান বিয়ার বা সূর্য ভালুক। সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি বনাঞ্চলে এদের বাস। মা ও শাবক ছাড়া বাকি সব ভাল্লুকই একা বাস করে। তবে মাঝে মাঝে তারা দল বেঁধে খাবার খোঁজে। এ সময় বিশাল এলাকা ঘুরে বেড়ায়। ভাল্লুক খাবার সংগ্রহের পথ মনে রাখতে পারে। অধিকাংশ ভাল্লুকই গাছে চড়তে পারে। তাদের শক্তিশালী থাবা ও ধারালো নখ এ কাজে সাহায্য করে।
বাংলাদেশের পাহাড়ি বনে যে দুটি ভাল্লুক আছে তাদের স্বভাব প্রায় একরকম। কালো ভাল্লুক দিন রাত সমান সক্রিয়। এরা জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ি বনে, সমতল বনে থাকতে পছন্দ করে। কালো ভাল্লুক পাহাড়ে এবং গাছে উঠতে দক্ষ। এরা একা থাকে। কালো ভাল্লুক বিভিন্ন কীটপতঙ্গ, ফলমূল ও মধু খায়।
ঝগড়া করার সময় ভালুক প্রতিপক্ষকে ভয় দেখানোর জন্য দুই পায়ে দাঁড়িয়ে যায়। কালো ভাল্লুক সাধারণত মানুষকে খাবারের জন্য আক্রমণ করে না। ভয় পেয়ে বা নিজের বা বাচ্চার নিরাপত্তার কারণে মানুষকে আক্রমণ করে থাকে। এরা সচরাচর লোকালয়ে আসে না, গভীর বনেই বিচরণ করে থাকে।