
বাংলাদেশ থেকে ৬৯ গুণ বড় ইউরোপ। কিন্তু এ দেশে যে পাখ-পাখালির প্রজাতিগত বৈচিত্র্য আছে তা নেই সেখানে। পাখিদের বিচিত্র রঙ, রূপ- মাধুর্য বাংলার মানুষের কাছে এক ভালোলাগার প্রাণী হিসেবে পরিগণিত। কিন্তু নানা কারণে এ দেশে এখন অনিরাপদ পাখিরা, বিশেষ করে জলচর পাখিরা।
প্রতিবছর জলাভূমিকে কেন্দ্র করে বিপুল সংখ্যক পরিযায়ী পাখি এ দেশ ভ্রমণে আসে। বাংলাদেশকে বলা হয় নদীমাতৃক দেশ, জালের মত ছড়িয়ে আছে সাতশোর বেশি নদী। ফলে তৈরি হয়েছে জলাভূমির এক অপূর্ব ভান্ডার। খাল, বিল, হাওর-বাওর ও ঝিলে পরিপূর্ণ এ দেশ প্রকৃতিগতভাবেই হয়ে উঠেছে জলচর পাখির আশ্রয়স্থল।
বাংলাদেশে রয়েছে সাতশো’র বেশি পাখির প্রজাতিগত বৈচিত্র্য। আর ভারতীয় উপমহাদেশে ১২শ ও বিশ্বে প্রায় দশ হাজার। এ দেশে জলাধার বা জলাভূমি কেন্দ্র করে পাখিদের একটি বড় অবস্থান আছে। ত্রিশ প্রজাতির বুনোহাঁস, চার প্রজাতির ডুবুরি, পনেরো প্রজাতির প্যারাপাখি, ঝিল্লি, কালেম, কোড়া, কুট, সারস, ডাহুক জাতীয় পাখি, আট প্রজাতির শামুকখোল, মানিকজোড়, মদনটাক জাতীয় পাখি, চার প্রজাতির কাস্তেচরা, চামচঠুটি জাতীয় পাখি, আঠারো প্রজাতির বগলা, দুই প্রজাতির গগনবেড়, ছয় প্রজাতির সাপপাখি, পানকৌড়ি, বুবি। আছে ৮৩ প্রজাতির সৈকত পাখি। পাশাপাশি রয়েছে মাছরাঙা, খঞ্জন ও শিকারি পাখিরা। যারা খাদ্যের প্রয়োজন মেটায় জলাভূমি।
এ দেশে জনসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মানুষের খাদ্যসহ মৌলিক চাহিদা পূরণের নানা খাতও। যার চাপ পড়ছে জলাভূমির ওপর এবং ক্রমেই ভরাট হচ্ছে জলাশয়। এতে বিলীন হচ্ছে পরিবেশের গুণগত মান ও পাখির আশ্রয়স্থল। গত চার বছরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের জলাভূমির বন্যপ্রাণী নিয়ে গবেষণার প্রেক্ষিতে দেখেছি নগরায়নের প্রভাবে জলাভূমিগুলো ক্রমশ ভরাট হয়ে নির্মাণ হচ্ছে নিত্য-নতুন আধুনিক বাড়িঘর ও কলকারখানা। মানুষের বসবাসের বন্দোবস্ত ঠিকঠাক হলেও আবাসস্থল হারাচ্ছে জলচর পাখিরা।

এ দেশে শহর এলাকার জলাভূমিগুলোর অবস্থা একেবারেই নাজুক। পাখিসহ সকল বন্যপ্রাণী তাদের তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে যাচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। এক সময় রাজধানী ঢাকায় ছিলো বড় বড় জলাশয়। সেসবে নিরাপদে উড়ে বেড়াতো নানা প্রজাতির বুনো হাঁসসহ বিভিন্ন পাখি। কিন্তু সেসব জলাশয় এখন রয়েছে শুধু গল্পে নয়তো ইতিহাসে।
অতিরিক্ত বায়ু ও শব্দ দূষণ, কলকারখানার বর্জ্য, জমিতে কীটনাশক প্রয়োগসহ নানা কারণে বিনষ্ট হচ্ছে জলাশয়ের গুনাগুণ। রাসায়নিক বিষক্রিয়ায় পাখির মৃত্যুর খবরও মিলছে অহরহ। গেল ২০২০ সালে ফেনীতে ধলালেজ ঈগল বিষক্রিয়ায় মারা গিয়েছিল বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। যা এ দেশের জলচর পাখিদের জন্য অশনিসংকেত।
জলাশয়গুলোর পানি ও পরিবেশের গুনাগুণ নষ্ট হওয়াতে ঠিকমতো খাদ্য উপাদান পাচ্ছে না পাখিরা। পাশাপাশি সৌন্দর্যবর্ধনের নামে শহর বা গ্রামের জলাশয়গুলোর প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে। সঙ্গে তো প্লাস্টিক দূষণ তো রয়েছেই। ফলে অনেক জলাশয়ে হয়ে পড়ছে পাখি শূন্য।
মর্মান্তিক বিষয় হলো নির্বিচারে জলচর পাখি হত্যা। শীত মৌসুম এলে এ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কতিপয় ব্যক্তিদের রসনার শিকার হচ্ছে পাখিরা। বিশেষ করে পরিযায়ী পাখিসহ বক, বুনো হাঁস, ডাহুক, কালেমের মতো পাখি বেশি ঝুঁকিতে। বিষটোপ, এয়ারগান, ফাঁদ ব্যবহার তো ব্যবহার করা হয়ই। তবে এখন পাখির ডাক নকল করে বাঁশি বাজিয়ে ও মোবাইল বা সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহারের মাধ্যমে হচ্ছে পাখি শিকার। এয়ারগান সম্প্রতি নিষিদ্ধ করা হলেও তা কতজন মেনে চলছে এটা পর্যবেক্ষণ করা জরুরি।

গণমানুষের সঙ্গে আলাপ করলে উঠে আসে আগের মতো আর দেখা যায় না বৈচিত্র্যময় পাখি। কারণ একটাই- হারিয়ে যাচ্ছে জলাশয়, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও শিকার বৃদ্ধি পাওয়া। কিছু জলাশয়ে মাছ চাষ বেড়েছে, ফলে মাছ রক্ষায়ও হত্যা করা হচ্ছে পাখি। কিন্তু জানার বিষয় হলো- জলচর পাখিরা জলাশয়ের মাছ খেয়ে অর্থনৈতিক ক্ষতি করে না বরং অসুস্থ মাছ খেয়ে মাছের মহামারী থেকে রক্ষা করে জলাশয়কে।
হাওর-বাওরের জলচর পাখিরা ভুমিকা রাখছে কৃষি অর্থনীতি ও মাছ উৎপাদনেও। প্রতিদিন প্রায় এক টন পরিমাণ বিষ্ঠা নির্গত করে পরিযায়ী পাখিরা। যা জলাশয়ে জৈব সার হিসেবে কাজ করে। একদিকে মাছের খাদ্য হিসেবে ভূমিকা রাখছে এবং মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি বৃদ্ধি করছে জলাশয়গুলোর চারপাশের জমির উর্বরতাও। ফলে ফসলের উৎপাদন বহুগুণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জলচর পাখি সংরক্ষণে সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে তাদের আবাসস্থল সংরক্ষণে। আবাসস্থলের ভৌত গঠন, গুনাগুণ ও প্রকৃতিক পরিবেশ ঠিক রাখতে হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ জরুরি। স্থানীয় পর্যায়ে জনসাধারণের মাঝে সচেতনমূলক অনুষ্ঠান আয়োজন করতে হবে, বিশেষ করে যুক্ত করতে হবে তরুণদের। তারাই বেশি ভূমিকা রাখবে পাখিদের সংরক্ষণে।