সমুদ্রের অগভীর অঞ্চলে শিকড়, ডালপালা ও পাতাবিহীন এক ধরণের উদ্ভিদ জন্মায়, যা পরিচিত সী-উইড বা সামুদ্রিক শৈবাল নামে। সাধারণত পাথর, বালি, পরিত্যক্ত জাল, খোলস বা অন্যান্য শক্ত অবকাঠামোতে জন্মায় এই উদ্ভিদ। লাল, বাদামী ও সবুজ এই তিন ধরণের হয়ে থাকে সামুদ্রিক শৈবাল। বাদামী এবং সবুজ সামুদ্রিক শৈবাল সাধারণত খাওয়া যায়। তবে বাদামী ও লাল হাইড্রোকলয়েড উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়।
১৬৪০ সালের দিকে টোকিও উপসাগরে সর্বপ্রথম শুরু হয়েছিল সী-উইডের চাষ। বাণিজ্যিকভাবে প্রথম সামুদ্রিক শৈবাল চাষ শুরু হয়েছিল ১৯৪০ সালে। বিশ্বব্যাপী সামুদ্রিক শৈবালের ব্যাপক চাহিদার জন্য ১৯৭০’র শুরুর দিকেই বিপ্লব ঘটে শৈবাল চাষে। বর্তমানে সামুদ্রিক শৈবালের বৈশ্বিক চাহিদা ২৬ মিলিয়ন টন। এর বাজারমূল্য ৬.৫ বিলিয়ন ডলার। এশিয়ার দেশগুলো (চীন, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, জাপান, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড) মূলত মোট চাহিদার ৮০ শতাংশ উৎপাদন করে। চীন একাই উৎপাদন করে মোট চাহিদার প্রায় ৪০ শতাংশ।
সামুদ্রিক শৈবাল খাদ্য হিসেবে অত্যন্ত পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ। এতে রয়েছে প্রোটিন, ভিটামিন, লৌহ, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট, বিটা ক্যারোটিন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, সালফার, কপার, জিংক, কোবাল্ট ও আয়োডিন। ভিটামিন বি১, বি২, বি৩, বি৬, ভিটামিন ‘কে’ এবং ভিটামিন ‘ডি’ রয়েছে। লাল ও বাদামি বর্ণের শৈবালে ক্যারোটিন নামে এক ধরনের উপাদান আছে, যা মানবদেহে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।
ডায়রিয়া এবং টিউমার বৃদ্ধি রোধ ও প্রতিরোধ করে। এতে বিদ্যমান ক্যারাজিনান মানবদেহের উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সহায়তা করে। স্পিরুলিনা শৈবাল দেহের হজম শক্তি বৃদ্ধি, রোগজীবাণু থেকে রক্ষা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। যা এইডস প্রতিরোধে সহায়ক। সামুদ্রিক শৈবাল থেকে ‘সি হুড মিল্ক শ্যেক’ নামে এক ধরনের খাবার তৈরি করা হয়। এটি নাস্তা ও ভাতের বিপরীতে খাওয়া যায়।
বাংলাদেশে দশ লাখেরও বেশি মানুষ ভুগছে গলগন্ড রোগে। অধিকাংশ শৈবালে সমুদ্রের পানির চেয়ে বেশি আয়োডিন রয়েছে, যা ওষুধ বা লবণ থেকে হতে পারে সমৃদ্ধ বিকল্প। এতে দুধের চেয়েও দশগুণ বেশি রয়েছে ক্যালসিয়াম, যা শরীরে সহজে হজমযোগ্য। চীন ও জাপানে জনগণের খাদ্যাভ্যাসে শৈবাল রাখায় ক্যান্সারের ঝুঁকি দেশ দুটিতে অনেক কম।
শৈবাল সার উৎপাদন, সমুদ্রের দূষণ রোধেও ভূমিকা রাখে। শৈবালের পাঁচটি প্রজাতি থেকে গাড়ি ও বিদ্যুৎতের জ্বালানি হিসেবে বায়োফুয়েল, বায়োইথানল, বায়োহাইড্রোকার্বন, বায়োহাইড্রোজেন। যা দিয়ে তৈরি করা যায় হেলিকপ্টারের জ্বালানি। এসবের উচ্ছিষ্ট অংশ থেকে বায়োগ্যাস তৈরি হয়। তৈরি করা যায় জৈব সারও। যুক্তরাজ্যের গবেষকদের মতে, আগামীতে বৈশ্বিক জ্বালানি চাহিদার ৮০ শতাংশ তৈরি হবে সামুদ্রিক শৈবাল থেকে।
এ দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং বিশাল উপকূলীয় এলাকা সী-উইড চাষের জন্য উপযুক্ত। দেশের ৭১০ কিলোমিটারব্যাপী দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত ও ২৫ হাজার বর্গকিলোমিটারব্যাপী উপকূলীয় অঞ্চলের বালি, পাথর, শিলা ও কর্দমাক্ত ভিজা মাটি শৈবাল চাষের জন্য খুবই উপযুক্ত। কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও বাগেরহাট জেলার উপকূলীয় অঞ্চলগুলো সামুদ্রিক শৈবাল চাষের জন্য খুবই উপযোগী।
সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ এলাকা শৈবাল চাষের সবচেয়ে উপযুক্ত, যেখানে পরিকল্পিত ও বাণিজ্যিকভাবে সামুদ্রিক শৈবাল চাষ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সরকারের সমুদ্র অর্থনীতি কার্যক্রমে সামুদ্রিক শৈবালকে সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক ফসল হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। দেশে এখনও সামুদ্রিক শৈবাল চাষ প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। দেশের দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে স্থানীয় কিছু বাসিন্দা শৈবাল চাষের সঙ্গে জড়িত রয়েছে।
বর্তমানে টেকনাফ উপজেলার সেন্টমার্টিন্স দ্বীপ, শাহ্পরীর দ্বীপ ও জালিয়াপাড়া এলাকায় নাফ নদীর তীর, উখিয়ার ইনানী এলাকার রেজু খালের তীরে এবং নুনিয়ারছরাতে চাষ হচ্ছে শৈবাল। এ সকল চাষী বছরে দু’প্রজাতির শৈবাল গড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ মণ উৎপাদন করছে। আরো অনেকেই রয়েছে, যারা সংগ্রহ করছে প্রায় এক থেকে দেড় হাজার মণ প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত শৈবাল। টেকনাফে সামুদ্রিক শৈবালকে আঞ্চলিকভাবে বলা হয় ‘হেজেলা’।
সেন্টমার্টিন্স অঞ্চলের লোকজন হেজেলা বা সামুদ্রিক শৈবাল সংগ্রহ করে অল্প দামে বিক্রি করছে পাশ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারে। আর মিয়ানমার থেকে তা চলে যায় চীন, কোরিয়া, জাপানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। স্থানীয়রা সাধারণত নভেম্বর-জানুয়ারি মাসে সমুদ্র থেকে শৈবাল সংগ্রহ করে। সেন্টমার্টিন্স দ্বীপের বাসিন্দারা এপ্রিল-মে মাসে অল্প পরিসরে সামুদ্রিক শৈবাল সংগ্রহ করে। মূলত নভেম্বর থেকে এপ্রিল এই ছয় মাস সামুদ্রিক শৈবাল চাষ করা সম্ভব। আমাদের দেশে শীতকাল বৃষ্টিহীন ও সাগরের পানির লবনাক্ততা বেশি থাকায় ওই সময় শৈবাল চাষের জন্য উৎকৃষ্ট সময়।
শৈবালভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলার জন্য বাংলাদেশের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। প্রাকৃতিকভাবেই উপকূলীয় অঞ্চলে সামুদ্রিক শৈবাল চাষের জন্য বিপুল পরিমাণ খালি জমি রয়েছে। শৈবাল চাষে খরচ কম কিন্তু আয় অনেক বেশি, যা বিপুলসংখ্যক লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারে। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ৭৬টি উপজেলার বাসিন্দারা বেশির ভাগই মৎস্য আহরণ, বিপণন ও মৎস্য সংক্রান্ত কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এদের বিকল্প আয়ের বড় একটি উৎস হতে পারে সামুদ্রিক শৈবাল চাষ।
দেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে বাণিজ্যিকভাবে শৈবাল চাষ করা হলে একদিকে যেমন প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা হবে, অন্যদিকে হাজারও নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানসহ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ তৈরি হবে। জাপানের জিডিপির ২১ শতাংশ আসে সামুদ্রিক শৈবাল রপ্তানি ও এ থেকে উৎপাদিত সামগ্রী থেকে। চীনের ১৪-১৫ শতাংশ ও কোরিয়ার ৮-১০ শতাংশ জিডিপি গড়ে এ খাত থেকে আসে। বর্তমানে বিজনেস প্রমোশন কাউন্সিলের অর্থায়নে বাংলাদেশ মেরিন ফিসারিজ এসোসিয়েশন কক্সবাজারের রেজুখালে শৈবাল চাষের একটি পাইলট বাস্তবায়ন করছে।
আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে মিয়ানমার ও ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা জয়ের পর বিপুল পরিমাণ সমুদ্রসীমা বাংলাদেশের অধীনে আসায় সরকার ‘ব্লু-ইকোনমির’ প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে সমুদ্র সম্পদকে কাজে লাগানোর ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছেন স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ‘ব্লু-ইকোনমির’ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল সী-উইড বা সামুদ্রিক শৈবাল । তাই সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশি-বিদেশি এনজিও এবং উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে।