বাঘ বৃদ্ধিতে প্রয়োজন জিনগত বৈচিত্র

চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় সাদা বাঘের পরিচর্যায় লেখক।

আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিষয়ক সংস্থা-ডব্লিউডব্লিউএফ এর তথ্যমতে, বর্তমানে পৃথিবীতে ৩৮৯০টি বাঘ আছে। এরমধ্যে সবচে বেশি বাঘ রয়েছে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। যা নতুন বাঘ শুমারি অনুযায়ী প্রায় তিন হাজার।

বাংলাদেশ বাঘের সংখ্যার দিক থেকে সপ্তম স্থানে রয়েছে, সংখ্যা ১১৪টি।

নেপালে ২৩৫টি, ভুটানে ১০৩টি, থাইল্যান্ডে ১৮৯টি, মালায়শিয়াতে ২৫০-৩৪০টি, রাশিয়াতে ৫৪০টি, চীনে ৫০টি, লাওসে ১৭টি ও ভিয়েতনামে রয়েছে ৫টি বাঘ।

গত এক দশকে উল্লেখযোগ্য হারে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ভারত, নেপাল, রাশিয়া ও ভুটানে।

ডব্লিউডব্লিউএফ-এর তথ্যমতে, ২০০৬ সালে ভারতের বাঘ সংখ্যা ছিল ১৪১১টি যা ২০১০ সালে বেড়ে হয় ১৭০৬টি এবং ২০১৪ সালের গননা অনুযায়ী সংখ্যা হয় ২২২৬টি।

অন্যদিকে ভুটানে ২০১০ সালে বাঘের সংখ্যা ছিল ৭৫টি, যা ২০১৪ সালের গণনায় ১০৩টি। নেপালে ২০০৯ সালে বাঘ সংখ্যা ছিল ১২১টি, যা ২০১৮ সালের মধ্যে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ২৩৫টি।

২০০৫ সালের গণনায় রাশিয়ায় বাঘের সংখ্যা ছিল ৪২৩টি, যা ২০১৫ সালে  হয় ৫৪০টি।

অন্যদিকে বাংলাদেশে ২০০৪ সালে যেখানে বাঘ সংখ্যা ছিল ৪৪০টি, সেটি ২০১৫ সালের শুমারিতে হ্রাস পেয়ে ১০৬টি।

তবে সম্প্রতি প্রকাশিত ২০১৮ সালের গণনা প্রতিবেন অনুযায়ী, বাঘ সংখ্যা ১১৪টি। অর্থাৎ বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র ৮টি, যা আশানুরূপ নয়।

চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা ছানাদের সঙ্গে বেঙ্গল টাইগার। ছবি: বেঙ্গল ডিসকাভার

বাঘের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি না পাওয়ার নানান কারণের মধ্যে যেমন সুন্দরবনে অবাধ চলাচল, বাঘ-মানুষ সংঘর্ষ, খাবার সংকট, পাশাপাশি রয়েছে জিনগত কারণও।

সুন্দরবনে বাঘ সংখ্যা সীমিত হওয়ায় প্রজননে জিনগত বৈচিত্র সাধিত হচ্ছে না। একইসঙ্গে অল্প সংখ্যক বাঘ থাকায় এদের মধ্যে ইনব্রিডিং তথা নিকট সম্পর্কের মধ্যে প্রজনন হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এতে মরণ জিন প্রকাশ পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যা প্রবল করে শাবক মৃত্যুহার বৃদ্ধিতে।

তাই বাঘ সংরক্ষণে মানুষ ও প্রাকৃতিক কারণগুলো ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি জিনগত বিষয়টি দিকেও নজর দিতে হবে। এজন্য বাঘের জিনে বৈচিত্রও আনা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে হেটারোজেনিসিটি বৃদ্ধি করতে পারলে আশা করা যায় বৃদ্ধি পাবে বাঘ সংখ্যাও।

যেভাবে সম্ভব সুন্দরবনে বাঘ বৃদ্ধি:

কার্যকর পদ্ধতি হতে পারে রি-ইন্ট্রোডাকশান। এই পদ্ধতিতে দেশের বিভিন্ন উৎস (চিড়িয়াখানা ও সাফারি পার্ক) থেকে বাছাই করা বাঘ নিয়ে প্রজনন ঘটানো যেতে পারে। যেটির তত্ত্বাবধান করবেন বাঘ বিশেষজ্ঞরা।

এরপর প্রজনন করা বাঘগুলোকে প্রশিক্ষণ দিয়ে শুরুতে আধা-বন্য পরিবেশে সীমাবদ্ধ রাখা যেতে পারে। পরবর্তীতে বন্য পরিবেশে উন্মুক্ত করে সাধন করা যেতে পারে জিনগত বৈচিত্র।

সুন্দরবনের বাঘ। ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বের কয়েকটি দেশে রি-ইন্ট্রোডাকশান কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে প্রাথমিক ধাপ হিসেবে চিড়িয়াখানা ও সাফারি পার্কের বাঘের মধ্যে সমন্বয়পূর্বক আদান-প্রদান করা যেতে পারে। পর্যায়ক্রমে ওই বাঘগুলো বন্য পরিবেশে উন্মক্ত করে জিনগত বৈচিত্রপূর্ণ বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি করা সম্ভব।

উল্লেখ্য, জিনগত বৈচিত্র আনা হলে বাঘের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। সেইসঙ্গে যেকোন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর মাধ্যমে বাঘকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করবে।

তবে পাশাপাশি বাঘ রক্ষায় সুন্দরবনকেন্দ্রিক নিতে হবে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা।

বাঘ রক্ষায় করণীয়:

সুন্দরবনের ভেতরে জনসাধারণের প্রবেশ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে।

বনে যদি মানুষের বসবাস থেকে থাকে তবে তাদের সুন্দরবন থেকে সরিয়ে করে অন্যত্র পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।

সুন্দরবনে মধু, কাঠ, গোলপাতা সংগ্রহ এবং মাছ শিকার বন্ধ করতে হবে। এসবের উপর নির্ভরশীল জনসাধারণকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং কৃত্রিম উপায়ে মধু, গবাদিপশু ও মাছ  চাষের প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করতে হবে। এছাড়া প্রতিটি পরিবারে বায়োগ্যাস স্থাপন করতে হবে।

সুন্দরবনের বাঘ। ছবি: সংগৃহীত

সুন্দরবন ঘেষা লোকালয়গুলোতে জাল বা বেড়া তৈরি করে মানুষের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখতে হবে বাঘসহ বন্যপ্রাণী। সোলার প্যানেল স্থাপন করেও কমানো যেতে পারে বাঘের প্রবেশ।

সুন্দরবনের অপরাধপ্রবণ এবং অবৈধভাবে মানুষের চলাচল বেশি, সেসব এলাকাকে সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের আওতায় আনা যেতে পারে।

বাঘের পর্যাপ্ত খাবার নিশ্চিত করতে সুন্দরবনের কাছাকাছি হরিণ ও শূকর এর খামার করে; শূকর, হরিণের বংশ বাড়িয়ে তা সুন্দরবনে বাঘের জন্য প্রেরণ করা যেতে পারে।

সুন্দরবনের লবণাক্ততা দূর করার জন্য এবং সুপেয় নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করার জন্য প্রাকৃতিক জলাধারের ব্যবস্থা করতে হবে।

বাঘের আক্রমনে নিহত ও আহত মানুষ ও গবাদিপশুর জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে।

বাংলার জীববৈচিত্র্য ও  প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঠেকাতে বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলকে রক্ষায় সুন্দরবন এবং বাঘের বিকল্প নেই। তা না হলে বন উজাড় হবে, অতিরিক্ত জোয়ারভাটার কারণে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হবে, বৃদ্ধি পাবে লবণাক্ততা। এতে ফসল উৎপাদন যেমন কমবে, বাড়বে দারিদ্রতাও।

লেখক: ডেপুটি কিউরেটর, চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা, বাংলাদেশ 

***প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বেঙ্গল ডিসকাভার কর্তৃপক্ষ লেখকের মতামতের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।