না-এর দেশ ও কিছু ভ্রমণকারীর কাণ্ড!

নোটিশ বোর্ড: যত্রতত্র আবর্জনা না ফেলতে ভুটান কর্তৃপক্ষের অনুরোধ। ছবি: শুভদীপ অধিকারী

(শেষ-পর্ব) ভূটানে ছ’টা রাত কাটিয়ে বুঝি দেশটায় কিছুই নেই। শুধু পাহাড়, বনজঙ্গল, জং, মনাস্ট্রি আছে। আর আছে লোকজনের হাসিখুশি মুখ। আর কিছু নেই, যেমন- রাস্তায় বা যত্রতত্র আবর্জনা নেই, ট্রাফিক সিগন্যাল নেই, যেখানে সেখানে রাস্তা পেরোনো নেই, রাস্তায় থুথু ফেলা বা টয়লেট করা নেই এবং প্রকাশ্যে ধূমপান করাও নেই।

সেইসঙ্গে ট্যাক্সি চালক পুলিশের খিটমিট নেই, মারাত্মক জোরে গাড়ি চালানো নেই, বিপদজনকভাবে ওভারটেক করা নেই, অযথা হর্ণ বাজানো নেই, যেখানে সেখানে গাড়ি পার্ক করা নেই, অযথা ট্রাফিক জ্যাম নেই…. সব মিলে না থাকার তালিকাটি বিশাল।

আসলে আমরা এমন দেশে থাকতে অভ্যস্ত যেখানে এই বিষয়গুলো খুবই সাধারণ ব্যাপার। তাই এগুলোর অনুপস্থিতি আমাদের রীতিমতো আশ্চর্য করে। আমরা হয়ত বলবো আমাদের জনসংখ্যার প্রবল চাপের কথা কিন্তু আমাদের মানসিকতা? সেটাও যে আমাদের নাগরিক দুর্ভোগের জন্যে অনেকাংশে দায়ী তা অস্বীকার করি কি করে।

ছবি: শুভদীপ অধিকারী

ভূটানের রাস্তাঘাটের পরিচ্ছন্নতার কথা আগেই বলেছি। খাবার পর চিপসের প্যাকেট, জলের বোতল বা আইসক্রিমের কাপ রাস্তায় যেখানে সেখানে ফেলার দৃশ্য, যা আমাদের দেশে খুবই সাধারণ তা কিন্তু এখানে একবারের জন্যেও দেখিনি। কাউকেই যেখানে সেখানে আবর্জনা ছুঁড়ে ফেলতে দেখিনি। সেগুলো নির্দিষ্ট জায়গাতেই ফেলা হয়।

স্থানীয়দের দেখেছি রাস্তায় কোনো প্যাকেট পড়ে থাকলে তা তুলে আবর্জনা ফেলার জায়গায় ফেলতে। বাজোতে সকালবেলায় দেখেছি কোনো বাসিন্দা বা দোকানি তার বাড়ি বা দোকানের সামনের রাস্তা, নর্দমা পরিষ্কার করে আবর্জনা এক জায়গায় করে রাখছেন। এখানকার বাজারে দেখেছি প্লাস্টিকের ক্যারি ব্যাগের ব্যবহার নেই। তবে বড় শহরের বসতি আর হোটেল চত্বরগুলো একটু বেশি অপরিচ্ছন্ন। বোঝাই যাচ্ছে এর একটা কারণ নাগরিক জীবনযাত্রা আর আমাদের মত পর্যটকরা।

যদিও সব জায়গাতেই বোর্ডে অনুরোধ করা আছে যেখানে সেখানে আবর্জনা না ফেলার জন্যে। এর অন্যথায় জরিমানার কথাও উল্লেখ করা আছে। আছে আবর্জনা ফেলার জন্যে নির্দিষ্ট জায়গা; আছে গার্বেজ বিন। পারো শহরের জনবহুল রাস্তায় যেখানে দুপাশে সারি দেওয়া কিউরিও শপ, ক্যাফেটেরিয়া, সেখানে কিছু দূর অন্তর অন্তর সারি দিয়ে রাখা আছে গার্বেজ বিন। বড় শহরের নিকাশি ব্যবস্থার হাল কিছুটা বেহাল। মনে হয় নিয়মিত পরিষ্কার হয় না। কাছে গেলে বেশ দুর্গন্ধ নাকে লাগে।

ছবি: শুভদীপ অধিকারী

তবে ট্যুরিস্ট স্পটগুলোকে যথা সম্ভব পরিচ্ছন্ন করে রাখার চেষ্টা করে স্থানীয় মানুষ ও প্রশাসন। সেখানে যেটুকু দৃষ্টিকটু এর দায় আমাদের মত পর্যটকদের। টাইগার নেস্টে যাবার পথে অনেক ভারতীয় পর্যটককে দেখেছি যেখানে সেখানে চকলেটের র‌্যাপার, জলের বোতল ছুড়ে ফেলতে।

আমাদের গাইড ডেচেন সেগুলো কুড়িয়ে তাদের এমন কাজ করতে বারণও করেছে। আবার অধিকাংশ পর্যটক তাদের আবর্জনা ব্যাগে রেখে পরে নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলে থাকেন। কিন্তু কিছু অবিবেচক ভারতীয় পর্যটকদের ব্যবহারের জন্যে অনেক ট্যুর গাইড ভারতীয়দের সম্পর্কে খুবই খারাপ মনোভাব পোষণ করেন।

পথচারি বা ট্রাফিক পুলিশকে রাস্তার ধারের নর্দমায় থুতু ফেলতে দেখলেও কেউই রাস্তার মাঝখানে থুথু ফেলতে দেখিনি। আমরা শিলিগুড়ি আসার পথে আমাদের গাড়ি চালককে বহুবার গাড়ির দরজা খুলে পিক ফেলতে দেখেছি। কিন্তু ভূটানে আমাদের গাড়ির চালক চেনচোকে একবারের জন্যেও এই কাজ করতে দেখিনি। যদিও পান আর সুপারি খাওয়া চেনচোর নেশা।

ছবি: শুভদীপ অধিকারী

রাস্তায় বা ফাঁকা জায়গায় এদেশের কাউকে টয়লেট করতেও দেখিনি। আমাদের দেশে এগুলো তেমন কোনো গুরুতর ব্যাপার নয়। এসবের সাথে আমরা যথেষ্ট অভ্যস্ত তাই বহু ভারতীয় পর্যটকদের দেখেছি রাস্তার ধারে গাড়ি থামিয়ে টয়লেট করতে। ওরাও মানুষ আমরাও মানুষ, তফাৎটা শিরদাঁড়া নয় তফাৎটা মানসিকতায় আর মূল্যবোধের। কিন্তু আশ্চর্যের কথা ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে আমাদের কলকাতার থেকে কম পাবলিক টয়লেট চোখে পড়েছে। গুরুত্বপূর্ণ সড়কের উপর বেশ কিছু রেস্ট রুম দেখেছি কিন্তু তাদের মধ্যে দূরত্ব ছিল অনেকটাই।

ভুটানের রাস্তায় কোনো ট্রাফিক সিগন্যাল নেই তবুও গাড়ি চালকদের নিয়মানুবর্তীতা দেখার মতন। ট্রাফিক পুলিশ থাকলেও তার সংখ্যা খুব কম। গুরুত্তপূর্ণ রাস্তার মোড় ছাড়া তাদের উপস্থিতি তেমন চোখে পড়েনি। রাস্তায় জেব্রা ক্রসিং আছে সেখান দিয়েই রাস্তা পার হতে হয়। আগেই বলেছি ট্রাফিক সিগন্যালের কোনো ব্যাপার নেই। যে কেউ রাস্তা পার হলে এমনিতেই গাড়ি দাঁড়িয়ে গিয়ে আপনাকে যাবার সুযোগ করে দেবে। তবে আমাদের মতন অধৈর্য পর্যটকদের এই সব ব্যাপারে অল্পতেই ধৈর্যচ্যুতি হয়। হাতের কাছে জেব্রা ক্রসিং না থাকলে গাড়ি আসছে না দেখে যেখান সেখান দিয়ে রাস্তা পেরোনোর দেশজ অভ্যাস আমাদের আর যাবে কোথায়?

রাস্তার ধারে গাড়ি পার্কিং-এর নির্দিষ্ট জায়গা আছে যেখানে দাগ দিয়ে গাড়ির জন্যে আলাদা আলাদা জায়গা চিহ্নিত করা থাকে। এর বাইরে যেখানে সেখানে গাড়ি পার্কিং-এর ব্যাপার নেই। পার্কিং-এর জন্যে বেশির ভাগ জায়গায় ঘণ্টা প্রতি টাকা দিতে হয়। সুবিধামত জায়গায় পার্কিং প্লেসে জায়গা না পাবার জন্য বেশ অনেকটা দূরে গিয়ে গাড়ি পার্ক করার মতন ঘটনাও ঘটেছে আমাদের সাথে। শহরের জনবহুল জায়গাতেও তেমন হর্ণের আওয়াজ শুনিনি। ওভারটেকের ব্যাপারও নেই।

থাইল্যান্ডের বৌদ্ধভিক্ষু এবং ট্যুর গাইড ডেচেন ও মাঝে লেখক

পাহাড়ি রাস্তায় বাঁকের মুখেও হর্ণ বাজানোর ব্যাপার নেই। একমাত্র হেয়ার পিন টার্নের জায়গায় চেনচোকে হর্ণ বাজাতে দেখেছি। এইরকম অনেক জায়গায় ব্লো হর্ণের সাইনও ছিল। ভুটানের রাস্তার বেশিরভাগটাই পাহাড়ের গা বেয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে তাই নিয়ম কানুন মেনে গাড়ি চালানোর ফলে বন্যপ্রাণীরা সুরক্ষিত থাকে। এই কথা মাথায় রেখেই প্রকৃতি আর পরিবেশ রক্ষার বার্তা দেওয়া আছে রাস্তার ধারে ধারে।

রাস্তায় বা প্রকাশ্যে ধূমপান করতে দেখিনি দেশটির নাগরিকদের। আমাদের দেশেও তো প্রকাশ্য স্থানে ধূমপান করা শাস্তি যোগ্য অপরাধ তবুও… এখানকার বাসিন্দারা যেখানে বলেছেন সিগারেট খেতে হলে লুকিয়ে খেতে হয়, সেখানে অনেক পর্যটককে দেখেছি প্রকাশ্যে ধূমপান করতে। তাদের সাথে ভূটানি ড্রাইভার বা গাইড থাকা সত্ত্বেও!

জনসংখ্যা বাড়ার সাথে দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকা নগরায়নের ফলে মূল্যবোধও দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে এখানে। আধুনিক হচ্ছে এখানকার যুব সম্প্রদায়। ভূটানে পুলিশের সংখ্যা খুব কম, সিভিক বা স্বঘোষিত মরাল পুলিশও নেই। তাই এই নিয়ম কানুন মেনে চলাটা নির্ভর করে নাগরিকদের সদিচ্ছার উপরে। তাই দিনে দিনে অধিকাংশ মানুষের মূল্যবোধের অবনতি হলে হয়ত গোটা ব্যবস্থাপনায় আস্তে আস্তে পরিবর্তিত হয়ে যাবে।

লেখক: গবেষক ও শিক্ষক, ভারত