(৫ম পর্ব): পারো শহরে তিনরাত কাটানোর সুবাদে শহরটায় হেঁটে ঘুরে বেড়ানোর অনেকটাই সুযোগ পাই। আমাদের হোটেল ছিল হোটেল কে.কে। হোটেলের কাছেই ছিল পারো ছু-র উপরে ব্রিজ। সেখান থেকে সূর্যাস্তের দারুণ ভিউ পাওয়া যায়। দূরে পারো জং আর ন্যাশানাল মিউজিয়ামও দেখা যায় এখান থেকে।
রাত সাড়ে সাতটার পর চারপাশটা মোটামুটি অন্ধকার হয়ে গেলে আলো জ্বলে ওঠে জং আর মিউজিয়ামে। সেই আকর্ষণে নদীর ধার দিয়ে নির্জন রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেছি জং-এর কাছ অবধি। না ভয়ের কিছুই ঘটেনি সেখানে।
ভূটানের ন্যাশানাল মিউজিয়ামটি আকারে অত্যন্ত ছোটো। শুনলাম ২০১১ সালের ভূমিকম্পে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মিউজিয়ামটি। এটিতে এখন চারটে গ্যালারিতে মুখোশ, রাজ পরিবারের ছবি, বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র ও পাত্র এবং জীববৈচিত্র্য নিয়ে নানান সামগ্রী ও তথ্য প্রদর্শিত রয়েছে। নিজের পছন্দের বিষয় হওয়ায় ভূটানের বায়োডাইভার্সিটি নিয়ে তথ্য নজর কাড়লো।
ভূটানের জাতীয় প্রজাপতি আছে জেনে বেশ আশ্চর্য হলাম।
প্রজাতিটি হল Ludlow’s Bhutan Swallowtail বা Ludlow’s Bhutan Glory (Bhutanitis ludlowi)। এই এনডেমিক প্রজাতিটি ১৯৩৩ সালে আবিষ্কৃত হয়। এরপর প্রায় ৭৬ বছর পর ২০১৭ সালে বমডেলিং ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি থেকে পুনারাবিস্কৃত হয়। যদিও ২০১২ সালেই এই প্রজাপতিকে ‘ন্যাশানাল বাটারফ্লাই অব ভূটান’ শিরোপা দেয়া হয়।
চেলে লা পাস (৩৯৮৮ মিটার) হল ভূটানের হাইয়েস্ট মোটরেবেল রোডগুলির মধ্যে অন্যতম। পারো আর হা ভ্যালির মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী এই পাস ভূটানের অন্যতম ট্যুরিস্ট অ্যাট্রাকশন। দুর্ভাগ্যক্রমে যখন চেলে লাতে গেছি তখন ভিড়ে ছয়লাপ। রীতিমতন গাড়ির জ্যাম লেগে গেছে। প্রকৃতিকে উপভোগ করার থেকে খাওয়া দাওয়া আর কেনাকাটিতেই বেশি উৎসাহ পর্যটকদের। আসে পাশের ছোটো ছোটো টিলাগুলোতে উঠতে উঠতে মেঘ কুয়াশা আর প্রেয়ার ফ্ল্যাগের মধ্যে হারিয়ে যেতে বেশ লাগে।
এখানে দেখি একদল ছেলে মহারাষ্ট্র থেকে বাইক চালিয়ে এসে হাজির হয়েছে। ধন্যি ছেলেদের অ্যাডভেঞ্চার প্রীতি। এদের দেখে আমার পরিচিত শমীক দা ওরফে অচল সিকির কথা মনে পড়লো। যে একা দিল্লি থেকে বাইকে লাদাখ ঘুরে এসেছে।
ভূটান ট্যুরের একমাত্র খাটাখাটনির পর্ব হল টাইগার নেস্ট ট্রেকিং বা হাইকিং। যদিও আমার মতন দুপুরে ভাত ঘুম দিতে পছন্দ করা টিপিক্যাল বাঙালির কাছে ট্রেকিং বা হাইকিং-এর কোনো পার্থক্য নেই। আদপে থাকলেও নেই, না থাকলেও নেই। এই জায়গাটা ট্যুরিস্টদের স্বর্গরাজ্য। যে যেমন করে পারছে লাফিয়ে, ধীরে সুস্থে বা প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে যাচ্ছেন। যথারীতি এখানেও ম্যাক্সিমামই ভারতীয়। বিভিন্ন প্রদেশের। কোন ভারতীয়কে ব্লু -টুথ স্পিকারে গান চালিয়ে যেতে দেখলেই অন্যান্য ভারতীয় সহযাত্রীরা তাকে চরম বকাঝকা করছেন।
নব্য বিবাহিত বাঙালি কাপল উঠছেন কম, ছবি তুলছেন বেশি। ঠান্ডা পানীয়ের বোতল জঙ্গলে ছুঁড়ে ফেলতেই স্ত্রীর মৃদু ভৎসনা স্বামীকে। স্বামীর অজুহাত কেউ দেখেনি। আমি পিছন থেকে ওনাদের পাশ কাটিয়ে উঠে আসতে আসতে বলি- সবাই কিছু না কিছু ঠিকই দেখে। ভদ্রলোকের হাঁ করা মুখের দিকে আর ফিরে তাকাইনি।
অনেক কষ্ট করে হলেও লক্ষ্যে পৌঁছেছিলাম ঠিকই। মিস করতে চাইনি এই সুযোগ। জীবনে এই সুযোগ আবার আসবে কিনা জানা নেই- তাই যে সুযোগ ছিল তা হাতছাড়া করার প্রশ্নই ছিল না। ফেরার পথে দেখা হয় থাইল্যান্ডের এক বৌদ্ধ ভিক্ষুর সাথে। বুদ্ধের টানে ঘর ছেড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ভারতেও এসেছেন। ঘুরে গেছেন বোধগয়া, সাঁচি, সারনাথ আর বেনারস। সারা পৃথিবীতে বুদ্ধের শান্তির বাণী ছড়িয়ে দিতে চান। ওনার সাথে কথা বলে অদ্ভুত এক মানসিক প্রশান্তি হল। ওনার মতন আমিও বেশি কিছু চাই না, শুধু চাই- “ধর্ম বলতে মানুষ বুঝবে মানুষ শুধু”।
লেখক: গবেষক ও শিক্ষক, ভারত
চলবে… (শেষ পর্ব- আগামীকাল)