বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ বানর সংকটাপন্ন

লাউয়াছরা জাতীয় উদ্যানে ডুমুর ফল খাচ্ছেমহাবিপন্ন চশমাপরা হনুমান। ছবি: লেখক

বিশ্বে প্রাইমেট বর্গের ৭৯ গোত্রের প্রায় ৫০৪ প্রজাতির বানর জাতীয় প্রাণী রয়েছে। ২০১৭ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, এদের ৬০ শতাংশ প্রজাতিই মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। আর ৭০ শতাংশ প্রজাতিতেই সদস্য সংখ্যা কমে যাচ্ছে আশঙ্কাজনকভাবে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে ১০ প্রজাতির বানর-নরবানর-হনুমানের অস্তিত্ব জানা যায়।

সবশেষ ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ক সংস্থা- আইইউসিএন বাংলাদেশ ১৬শ ১১টি প্রজাতির এ দেশীয় প্রাণীর লালতালিকা হালনাগাদ করে। সে তালিকায় দেশে দশ প্রজাতির বানরের ৯০ শতাংশ অর্থাৎ ৯ প্রজাতি বিপদাগ্রস্ত এবং এক প্রজাতি তথ্য ঘাটতি আছে- এমন শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত করে। ঝুঁকিপূর্ণ, বিপন্ন, এবং মহাবিপন্ন- এই তিন শ্রেণীকে বিপদাগ্রস্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়। কেননা এগুলোর প্রত্যেকেই বিলুপ্তির মুখে রয়েছে। ২০১৫ সালে ঐ দশ প্রজাতির বানরের ছয় প্রজাতিই বিশ্বে বিপদাগ্রস্ত প্রাণীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল।

আইইউসিএন ২০২০ সালের মধ্যে পৃথিবীর এক লাখ ৬০ হাজার প্রাণী প্রজাতির বৈশ্বিক লাল তালিকা হালনাগাদ শুরু করছে। গেল ১০ জুলাই অন্য প্রজাতির পাশাপাশি বাংলাদেশে প্রাপ্ত বানর-নরবানর-হনুমানগুলোর বর্তমান বৈশ্বিক অবস্থা হালনাগাদ করে। নতুন এ তালিকায় বাংলাদেশে পাওয়া যায় এমন প্রজাতির মধ্যে লম্বা-লেজী বানর ঝুঁকিতে এবং লজ্জাবতী বানর বিপন্ন হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে। এর মানে হলো, বর্তমানে বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ বানর-নরবানর-হনুমান প্রজাতি শুধুমাত্র দেশেই নয়, বিশ্বব্যাপী বিলুপ্তির হুমকিতে রয়েছে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে খাটো-লেজী বানর খুব সম্ভবত ইতিমধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে, এ প্রজাতির বানর সবশেষ দেখা গিয়েছিল ১৯৮৯ সালে। একইভাবে, সর্বশেষ ২০১২ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা জরিপে দেশে লম্বা-লেজী বানরের কেবল তিন সদস্যের একটি দলের কথা জানা যায়। অথচ ১৯৮৪ সালে দেশে এ প্রজাতির সদস্য সংখ্যা নিরূপন করা হয়েছিল প্রায় ২৫৩টি। লম্বা-লেজী বানরের সংখ্যা বিপদজনকভাবে কমে যাওয়ার মূল কারণ, এদের উপকূলীয় আবাস ও খাবার সংগ্রহের বড় গাছগুলো কেটে ফেলা, নাফ নদীর তীরে নতুন বসতি গড়ে তোলা, রোহিঙ্গা ক্যাম্প স্থাপন এবং বাণিজ্যিক চাষাবাদ। অন্য বানর প্রজাতিগুলোর জন্যও বিপদের কারণ অনেকটা একই রকম।

লাউয়াছরা জাতীয় উদ্যানের মুল ফটকেই দেখা মেলে মহাবিপন্ন উল্লুক।

মানুষ প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে বনভূমি ধ্বংস করছে। বড়সড় বনগুলো ছোট ছোট খণ্ড বনে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে, ফলে বাসস্থান ও খাদ্য সংকটে পড়তে যাচ্ছে বানরসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী। পাশাপাশি দেশে বানরের অবৈধ বাণিজ্য ও খাওয়ার জন্য শিকারের চাপ আছে। সীমিত খাদ্য নিয়ে প্রতিযোগিতায় মানুষ-বানরের সংঘর্ষের পরিমাণও বাড়ছে। উপরন্তু মানুষ-বানরের যুগপৎ অবস্থান না থাকায় দেশে বিষ দিয়ে বানর হত্যার মত ঘটনাও দেখা যাচ্ছে। করোনা দুর্যোগের সময়ে শখের পর্যটক ও সরকার কর্তৃক সরবরাহ করা পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাবে লোকালয় ও ফসলের জমিতে বানর উপদ্রব বেড়ে যাওয়ার খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়।

বনের ভিতর দিয়ে যাওয়া রাস্তায় গাড়ির নিচে চাপা পরে ও বিদ্যুৎতায়িত হয়েও মারা যায় বানর-হনুমান। আবার অবৈধভাবে বন থেকে গাছ চুরি আর বনের জমিতে কেবল কাষ্ঠল উদ্ভিদ লাগানো দুটোই সমান বিপদজনক ফল-পাতাভোজী এ প্রাণীগুলির জন্য। সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশের মহাবিপন্ন প্রাণী চশমাপরা হনুমান গত প্রায় তিন দশকে ৮০ শতাংশ কমে গেছে এবং গত দুই দশকে কমে গেছে ৯০ শতাংশ উল্লুক। তারপরও দেশে বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে থাকা এই বানর-হনুমানগুলো নিয়ে নেই পর্যাপ্ত গবেষণা এবং বাঘ-হাতির সংরক্ষণের মতো বড় উদ্যোগ।

বাংলাদেশে সবশেষ টিকে থাকা বানর-নরবানর-হনুমানগুলোকে সংরক্ষণের জন্য কার্যকরী উদ্যোগ নিতে এখনই চূড়ান্ত সময়। বাংলাদেশ বনবিভাগসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেন। তবে সাধারণ জনগণকে সচেতন ও সম্পৃক্ত করতে না পারলে সংরক্ষণের উদ্যোগ কখনোই টেকসই হবে না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও প্রাইমেটোলজিকাল সোসাইটি গড়ে তোলা যেতে পারে। এতে সম্মিলিতভাবে দেশে বানর জাতীয় প্রাণীগুলো নিয়ে গবেষণা ও সংরক্ষণে অভিজ্ঞদের পরামর্শে তরুণরাও কার্যকর অবদান রাখার সুযোগ পাবে।

Bengali Name English Name Scientific Name Status in Bangladesh* Global Status**
উল্লুক Western Hoolock Gibbon Hoolock hoolock CR EN
লজ্জাবতী বানর Bengal Slow Loris Nycticebus bengalensis EN EN
মুখপোড়া হনুমান Hanuman Langur Semnopithecus entellus EN LC
মুখপোড়া / লাল হনুমান Capped Langur Trachypithecus pileatus EN VU
চশমাপরা হনুমান Phayre’s Langur Trachypithecus phayrei CR EN
বানর, বান্দর, লাল বানর Rhesus Macaque Macaca mulatta VU LC
আসামী বানর Assamese Macaque Macaca assamensis EN NT
কলু / সিংহ বানর Northern Pig-tailed Macaque Macaca leonina EN VU
ছোট লেজী বানর Stump-tailed Macaque Macaca arctoides DD VU
লম্বা লেজী বানর Long-tailed Macaque Macaca fascicularis CR VU

টেবিল: বাংলাদেশের বানর-নরবানর-হনুমানের সংরক্ষণ স্ট্যাটাস

Aberrations: CR = Critically Endangered, EN = Endangered, VU = Vulnerable, NT = Near Threatened, LC = Least Concern, DD = Data Deficient; *IUCN Bangladesh (2015); ** IUCN (2020)

লেখক: বন্যপ্রাণী গবেষক ও আইইউসিএন বানর বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য, বাংলাদেশ।